২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাজারে আওয়ামী সিন্ডিকেট

- প্রতীকী ছবি

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বাজার ও রাজনীতিতে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজধানীর সবজির বাজারে চরম অস্থিরতা। তদারকির কোনো প্রভাবই নেই বরং চলছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বন্যা আর বৃষ্টির অজুহাত। সবজির বাজারের এমন নৈরাজ্যের কারণে জনমনে অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। ক্রেতারা বলছেন, জিনিসপত্রের অভাব নেই কিন্তু দাম বাড়ছেই। বাজার মনিটরিংয়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই।
পতিত সরকারের সমালোচনাকারী অনেকে মনে করছেন, তার অনুগত একটি করপোরেট সিন্ডিকেট এখনো বাজারে সক্রিয়, যারা বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করছে। অভিযোগ উঠেছে, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে এ সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই মাস পেরিয়ে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, তারা আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন ছিল, তা নেয়া হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ধীরগতির কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে এবং রাজধানীর বাজারে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগী জনগণ মনে করেন, করপোরেট হাউজগুলোর নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সাথে সচিবালয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো যেত। তারা দেশের ব্যবসায়ী হলেও, ব্যবসার স্বার্থে তাদের পক্ষ থেকে সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সরকারের উপদেষ্টাদের তরফে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
এ পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে, কারণ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

বাজারের অস্থিরতা ও সিন্ডিকেট নিয়ে নানা আলোচনা চলছে, বিশেষ করে এস আলম, বসুন্ধরা, মেঘনা, টিকে, সিটি এবং এসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ভ‚মিকা নিয়ে। তারা তেল, চাল, ডিম, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু মহল থেকে বলা হচ্ছে, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে, যা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে করা হতে পারে।

সারা দেশে টাস্কফোর্স গঠন করে বাজার তদারকির উদ্যোগ নেয়া হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না। সোমবার দেশের প্রতিটি জেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠনের পরও দাম বাড়ছে। সবজির বাজারেও পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে, যা ভোক্তাদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পণ্যের দাম কমানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্ককর কমিয়েছে সরকার এবং আরো কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনই বাজারে অভিযানের মাধ্যমে তদারকি করা হচ্ছে। তবে ভোক্তারা এখনো এর সুফল পাচ্ছেন না।

রাজধানীর বাজারে সবজির দাম হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির আরেক কারণ বন্যা। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শেষ ১০ দিনে ঢাকার বাজারে সব ধরনের সবজির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
মূল্য নিয়ন্ত্রণ এমন একটি অর্থনৈতিক নীতি যা সরকারের মাধ্যমে পণ্য ও পরিষেবার দামের ওপর নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। এটি বিভিন্ন প্রকারে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেমন দামের সর্বোচ্চ সীমা বা সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা। এর উদ্দেশ্য সাধারণত বাজারে অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। তবে এটি কেবল একটি অর্থনৈতিক নীতি নয়, বরং এটি একটি সামাজিক নীতিও হতে পারে যা ন্যায়বিচার, সাম্যতা এবং ক্রেতাদের সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রয়োগ করা হয়।

নাগরিকের জীবনকে আরো সহজ ও জিনিসপত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি এবং অত্যাবশ্যকীয় :
১. কৃষি ও খাদ্য পণ্য : সাধারণত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে যাতে নিম্ন আয়ের মানুষও খাদ্য ও প্রয়োজনীয় পণ্য সহজে কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করা। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে জিনিসপত্রের দাম নির্দিষ্ট ও দোকানে লটকিয়ে রাখতে হবে।

২. মধ্যস্বত্ব ও দালাল চক্রকে চিহ্নিত করা : উৎপাদক শ্রেণী তার পণ্য কত দামে বিক্রি করছে এবং রাজধানী শহরে আসার সাথে সাথে দালাল চক্র এর দাম তিন গুণ চার গুণ বাড়িয়ে দিয়ে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যায়। মাঝখানের এই দালাল চক্রকে চিহ্নিত না করতে পারলে উৎপাদক শ্রেণী যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি পুরো জাতির জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে ।

৩. প্রতিযোগিতা ও বাজার নিয়ন্ত্রণ : মূল্য নিয়ন্ত্রণ কখনো কখনো অবাধ প্রতিযোগিতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি সরবরাহ কম থাকে বা ব্যয় বেশি হয়ে যায়।

৪. বিকল্প সমাধান : মূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সরবরাহ বাড়ানোর জন্য উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি, ভর্তুকি এবং ক্রেতা-সুরক্ষা নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।

এটি সামগ্রিকভাবে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকেও লক্ষ রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করছি।

সরকারের দায়িত্বশীলরা এ বিষয়ে সচেতন থাকলেও, এখনো পর্যন্ত সিন্ডিকেট ভাঙার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য, জনগণের মাঝে অজনপ্রিয় করার জন্য এসব পতিত সরকারের ফ্যাসিস্ট প্রবণতার অংশ বলেই মানুষ মনে করছেন।

লেখক : শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail: shah1alamdu@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement