২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উপেক্ষিত

- প্রতীকী ছবি

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অবহেলিত; বিশেষ করে প্রথম শ্রেণী থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা উপেক্ষিত। অথচ শিশুদের ছেলেবেলা থেকে নৈতিকতা শিক্ষা দিতে হয়। আমরা ছেলেবেলায় পড়েছি- ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,/ সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।/ আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,/ আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।’

এই ছড়া পড়ে সব ধর্মের শিক্ষার্থী গুরুজনকে মান্য করাসহ আদর্শিক শিক্ষাগ্রহণ করত। এসব ছড়া পড়ে পড়ে শিশু-কিশোর বয়স থেকে, শিক্ষার্থীরা সার্বিকভাবে আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পেত। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সমাজের সাথে নৈতিকতার, প্রকৃতির, পিতা-মাতার, গুরুজনের সাথে একত্র হয়ে সমীহের বাধন সৃষ্টি করা। দেশের ভবিষ্যৎ প্রয়োজনে নিজেকে প্রস্তুত করা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।

বাল্যকাল থেকে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব থাকলেও আমাদের দেশে স্কুলপর্যায়ে স্বাধীনতার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা উপেক্ষিত। তাই বর্তমানে প্রথম শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে বিষয়ভিত্তিক পৃথক ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি উঠছে। বিশেষ করে শিশুদের মূল শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষায়। দীর্ঘকাল অবহেলিত হওয়ায় গত ৫ অক্টোবর ২০২৪ প্রাথমিক থেকে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে একজন আইনজীবী উকিল নোটিশ দিয়েছেন। দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশটি পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, অর্থ সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

লক্ষণীয়, মাধ্যমিক স্কুল ও মাদরাসায় প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের মূল প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত। বিশেষ করে মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল বিভাগে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য বিষয়ের মতো ধর্ম বিষয়টি শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পৃথক বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ধর্মীয় বিষয়ে একজন করে শিক্ষক অবিলম্বে নিয়োগ দেয়া। আমরা আশা করি, শিগগির সব শ্রেণীতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করবে অন্তর্বর্তী সরকার।

ভবিষ্যৎ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে দায়িত্ববোধ, সৃজনশীল ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে প্রয়োজন শিশু-কিশোরদের জন্য ভালো উপাদানের পাঠ্যপুস্তক। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো এবং আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির সাথে সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের যোগ্যতা সৃষ্টি করা শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীর মধ্যে বাবা-মায়ের ও গুরুজনের প্রতি সম্মান, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা শেখানো শিক্ষার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। মানবতাবোধসহ দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টি করতে হবে। মানুষ সৃষ্টির রহস্য এবং কার্যকরণ সম্পর্কে শিক্ষার্থীর চেতনাবোধ সৃষ্টি করাও শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে সুশিক্ষিত করে পরিবার, সমাজ ও দেশ গঠনের ভিত্তি তৈরির যোগ্যতাসম্পন্ন হয়। অথচ পতিত স্বৈরাচার হাসিনার শাসনামলে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমসহ সব স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়।

বিগত সরকারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠদান কর্মসূচি ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। শিক্ষাব্যবস্থায় আনা হয় নতুন কারিকুলাম এবং নতুন পাঠ্যবই। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল করে চালু করা হয় শিক্ষাকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন, যার মধ্যে রয়েছে- অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যায়ন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে অভিন্ন ১০টি বিষয়ে পাঠদান পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে পুনরায় বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ চালুর ঘোষণা দিয়েছে। সে জন্য সরকারকে মোবারকবাদ। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকসহ শিক্ষাব্যবস্থা ২০১০ সাল থেকে চালু করা এ কারিকুলাম বাতিল করে শিক্ষাবান্ধব পাঠদান কারিকুলাম ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তা ছাড়া করোনাকালীন অটো পাস ও দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিন্ডারগার্টেনসহ সব স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা।

অন্যদিকে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষক না থাকায় অনেক স্কুলে অমুসলিম শিক্ষকরাও পড়াচ্ছেন ইসলাম ধর্ম শিক্ষা। ওই সব স্কুলে কোনো মুসলিম শিক্ষক নেই। অন্য দিকে একই কারণে মুসলিম শিক্ষকরাও কোনো কোনো সময় ভিন্ন ধর্ম শিক্ষা পড়াচ্ছেন। যার কোনোটি স্বাভাবিক নয়। এমনটি হওয়া উচিত নয়।
কিছু স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা কম থাকায় অনেক বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস হয় না। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো ধর্মীয় শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের আরবি পড়া এবং লেখা ভালোভাবে শেখা সম্ভব হয় না। অবিলম্বে এসব সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি।

বাংলাদেশে বিদ্যমান সব মাধ্যমিক সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষকের পদ আছে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক পদ নেই, ফলে শিক্ষকও নেই। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষকের পদ না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে আরবি শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের আরবি ইসলামী শিক্ষা পড়া ও লেখা বুঝতে সমস্যা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা যথাযথভাবে শিখতে পারবে না। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক অবিলম্বে নিয়োগ দেয়া দরকার। তাহলে প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে। একই সাথে মাদরাসা শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। শিশু-কিশোরদের কোমল হৃদয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও মানবিকতা জাগ্রত হবে। এটা প্রমাণিত যে, ছেলেবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা না পেলে শিশুরা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে অন্যায়, জুলুম, খুন, সুদ, সন্ত্রাস, মাদক এবং উগ্রবাদ, ইভটিজিংসহ সামাজিক অপরাধে ঝুঁকে পড়ে।

শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত রেখে মানোন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। আগের মতো প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নিতে হবে। শ্রেণিভিত্তিক প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষা চালু করা এবং বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কারণ বর্তমান পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদের যোগ্যতাভিত্তিক নয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম সংস্কার করে ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করতে হবে।

বর্তমান পাঠ্যক্রম অনেকাংশে কাঙ্ক্ষিত নৈতিক মানে নেই। সব পাঠ্যপুস্তক নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে রচনা করে পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আগ্রহী করা ও মানসম্মত, যুগোপযোগী নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ তৈরি করার মানসম্মত কারিকুলাম প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট দেশে যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার সুফল পেতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সব শ্রেণীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তাই সবার প্রত্যাশা, বর্তমান সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সব সমস্যা সমাধানে শিগগির পদক্ষেপ নেবে। যাতে নৈতিকতাহীন শিক্ষা বাদ দিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। তাহলে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে নাগরিকরা মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন যোগ্য সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে সক্ষম হবে।

লেখক : কলেজশিক্ষক ও সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


আরো সংবাদ



premium cement