১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

অধিকাংশ হিন্দু আওয়ামী লীগের সমর্থক কেন

- প্রতীকী ছবি

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফ‚র্ত অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। দেড় সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে বিশ্ব কাঁপানো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারায় টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার রায় নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন শেখ হাসিনা।

একসময় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করা শেখ হাসিনা পরিচিত হন স্বৈরাচার ও গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও চরম দাম্ভিকতা শেখ হাসিনার এ করুণ পরিণতির জন্য দায়ী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মো: ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্যাপক রাষ্ট্রসংস্কারের অভীষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন অন্তর্বর্তী সরকার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও স্লোগান ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কিছু জায়গায় আক্রমণ হতে দেখা যায়। হিন্দু জনগোষ্ঠী এর প্রতিবাদ জানায়। সেই প্রেক্ষাপটে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জোগাতে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ছুটে যান প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এমন বাংলাদেশ আমরা করতে চাচ্ছি, যেটা আমরা এক পরিবারের মতো’। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের গণতন্ত্রের যে আকাঙ্খা সেখানে আমরা ধর্মের ভিত্তিতে বিবেচিত নই; আমরা মানুষ হিসেবে বিবেচিত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু হিসেবে আপনারা পরিচয় না দিয়ে তথা মূল সমস্যা থেকে সরে না গিয়ে একত্রিতভাবে আপনাদের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে।’ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনোবল না হারাতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বান নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘অতীত ভুলে যান, আমাদের এ প্রিয় দেশে যারা জন্মগ্রহণ করবে, তিনি যে ধর্মের বা দলের কিংবা নিরপেক্ষ হোক না কেন তিনি এ দেশের একজন গর্বিত মর্যাদাবান নাগরিক এবং সব নাগরিককে বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র যা দিয়েছে তা করুণা হিসেবে নয়; তার অধিকার হিসেবে তাকে দিয়েছে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা আশান্বিত হয়েছেন উপদেষ্টাদের কথায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়াও ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের নিয়ে একটি ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রধানের বক্তব্যেও বারবার সহমর্মিতার মনোভাব ব্যক্ত হতে দেখা যায়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সংখ্যালঘু হিন্দুরা আশান্বিত হয়েছিলেন। কিন্তু গত সাড়ে ১৫ বছরে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নিপীড়নের শিকার হয়েছেন উল্লেখযোগ্য হারে। মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে হিন্দুদের ওপর ৩৬৭৯টি হামলা হয়েছে। জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত সংগঠনটি সংখ্যালঘুদের মন্দির ও মূর্তির ওপর ১৮৭৯টি আক্রমণ এবং ২১৯০টি হামলার মামলা নথিভুক্ত করেছে। ‘ফ্যাক্ট চেক’ নিশ্চায়নের মাধ্যমে যথাসময়ে এসব হামলার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রকৃত চিত্র জানা যাবে।

২০২১ সালের অক্টোবরে দুর্গাপূজার সময় দেশে ১৫টি জেলায় কিছু হামলার শিকার হন হিন্দুরা। কুমিল্লায় প্রতিমার সামনে পবিত্র কুরআন রাখা ও পরবর্তীতে গ্রেফতার করা আসামিকে পাগল সাজিয়ে রেহাই দেয়ার নাটকটি চিত্রায়নে স্থানীয় কোন নেতার সংশ্লিষ্টতা ছিল তা সবারই জানা। রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লীতে আগুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা, খুলনার পাইকগাছায় হিন্দু বাড়িতে আগুন ও লুটপাট, শ্রীমঙ্গলের চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনকারী শ্রমিক প্রীতম দাসকে কিভাবে ধর্ম অবমাননাকারী হিসেবে ফাঁসিয়ে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগে ১৩১ দিন কারারুদ্ধ করাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার এবং এসব ঘটনার সাথে জড়িতরা তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়াতে আইনের ঊর্ধ্বে থেকে যাওয়া নিঃসন্দেহে সংঘটিত অপরাধগুলো এবং অপরাধীরা প্রত্যক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভ‚মিদস্যুগিরি করে হিন্দুদের জায়গা দখল নিতে মতাদর্শের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো ব্যবধান নেই। আবুল বারকাতের গবেষণা তথ্য মতে, ‘স্বাধীনতার পরে জমি দখলকারী অধিকাংশ ব্যক্তি পরে আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক রেখেছিলেন।’ এসব তথ্য সংখ্যালঘু রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দ্বৈত কৌশল উন্মোচিত করে।

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, এতদসত্তে¡ও সংখ্যালঘু হিন্দুরা কেন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে? বিকল্প কোনো দল বা জোট না থাকায় মন্দের ভালো হিসেবে তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে, নাকি অন্য দলগুলো সংখ্যালঘু হিন্দুদের আস্থায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে?

আবদুল গাফফার চৌধুরীর মতে, ‘এ দেশের হিন্দুরা অধিকাংশই শেখ হাসিনার ওপর নির্ভরশীল। হিন্দু ছাড়াও প্রগতিশীল মুসলমানরাও তার ওপর অগাধ আস্থা রেখে চলেছেন।’ আওয়ামী লীগও সংখ্যালঘু হিন্দুদের ‘একক ত্রাণকর্তা’ ও ‘অন্তরঙ্গ মিত্র’ বলে দাবি করে আসছে। একথা সত্য যে, প্রতিটি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সাধারণত ওই দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন করে। ভারতীয় মুসলিমরা কংগ্রেসের, এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক, বেশির ভাগ মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাট এবং অধিকাংশ মুসলিম ব্রিটিশ লেবার পার্টির সমর্থক।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগকে কতটুকু মধ্যপন্থী দল বলা যায়, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তাহলে হিন্দুরা কেন শুধু আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত হিন্দুদের মতামত নেয়ার চেষ্টা করেছি। এক ধর্মীয় নেতার মতে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের গতি-প্রকৃতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার ওপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শঙ্কিত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

দিন পাল্টেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে অনেক সংখ্যালঘু হিন্দু স্বপ্রবৃত্তে অংশগ্রহণ করেছেন। বেশ কয়েকজন হিন্দু ধর্মীয় লোক গুলিতে নিহত হয়েছেন। এতে করে একটা বার্তা পরিষ্কার যে, সংখ্যালঘুরা বিকল্প পেলে তাদের ওপর আস্থা রাখতে প্রস্তুত। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আস্থায় আনতে নীতিগত ও দৃশ্যমান আন্তরিকতা পোষণ করা। এক্ষেত্রে, ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন ও ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ এবং ‘সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়’ গঠন যেকোনো রাজনৈতিক দল বা জোটের জন্য ‘ট্রাম কার্ড’ হিসেবে কাজ করবে।

লেখক- প্রাবন্ধিক
rupanrupa@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement