২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাষ্ট্র মেরামত সময়ের দাবি

- প্রতীকী ছবি

সরকার পরিবর্তনশীল কিন্তু রাষ্ট্র অপরিবর্তনশীল। সরকার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। তবে সরকারের এমন কোনো কাজ বা কর্ম করা উচিত নয় যার কারণে রাষ্ট্র হুমকির মধ্যে পড়ে। আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সুবিবেচনা করে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রতিবেশীসহ সব দেশকে আমাদের আস্থায় রাখতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। পলিটিশিয়ান আর স্টেটসম্যান এক নয়। পলিটিশিয়ানরা ভাবেন এক নির্বাচন থেকে আরেক নির্বাচন পর্যন্ত, অন্যদিকে স্টেটসম্যানরা ভাবেন বহু দূরের ভবিষ্যৎ?

দেশ চালাবেন রাজনীতিবিদরা সন্দেহ নেই। তবে বুদ্ধিদীপ্ত, রাষ্ট্রচিন্তক বা দার্শনিকদের কিছু কিছু পরামর্শ বা আইডিয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামত। ২০০৭ সালে সংস্কার শব্দটির নিয়ে বড় বড় কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা কিঞ্চিৎ ভ‚মিকা রাখতে চাইলে তারা তখন দলীয় প্রধানের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন এবং একপর্যায়ে সংস্কারবাদীরা মাইনাস হয়ে পড়েন। ৩৬ দিনের একটানা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রক্তস্নাত বিপ্লবে ঘটিত হয়েছে বিপ্লবী বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার দেশে বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে তারা দৃঢ় প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। ইতোমধ্যে দেশ সংস্কারের জন্য ছয় বিশিষ্টজনকে প্রধান করে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। ধাপে ধাপে হয়তো আরো সংস্কার কমিশন গঠিত হতে পারে।

বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একেক দেশে একেক রকম। কোথাও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, কোথাও প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন, কোথাও কিছু আসন সামরিক বাহিনীর জন্য নির্ধারিত, কোথাও রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। আমাদের দেশে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চলমান। সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যনীতি বজায় রাখা উচিত। স্বাধীন বিচার বিভাগের বিচারপতিরা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগের আগে তাদেরকে সম্ভব হলে সংসদ বা মিডিয়ার মাধ্যমে উন্মুক্ত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আনতে হবে। কোনো অনৈতিক বা অসদাচরণ কর্মকাণ্ড তার আছে কি না, যাচাই-বাছাই করে তাদের শপথ পাঠ করাতে হবে।

বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভের পরে বিচারপতিরা কোনো দল বা নেতার পক্ষে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রশংসা বা নিন্দাসূচক কোনো লিখা লিখতে পারবেন না। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরো ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। আইন বিভাগের সদস্যরা আইনজ্ঞ বা আইন পাস হলে অগ্রাধিকার পাবেন। তারা শুধু আইন প্রণয়নে নিয়োজিত থাকবেন। কোনো রকম আর্থিক উন্নয়নে নিজেদের জড়াতে পারবেন না। স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন, স্থানীয় সরকারের বাজেটে পরিচালিত হবে। কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের চাহিদা যাচাই-বাছাই করে শাসন বিভাগের মাধ্যমে তা বরাদ্দ করবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো দলীয় মার্কা বা প্রতীক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যবহার করা যাবে না। সবাই একটি মাত্র আসনে নির্বাচন করবেন। যদি কোনো প্রার্থী নিজ আসনে জয়ী হতে না পারেন তাহলে তিনি সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। কেননা, তিনি ব্যক্তিগতভাবে জনপ্রিয় নন। তাহলে কেন তিনি সরকারপ্রধান হবেন? দলের স্বার্থে অন্যকে তাকেই সরকারপ্রধানের সুযোগ দিতে হবে। সরকারপ্রধান হওয়ার পর তাকে নিজ দলের দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। দল, সরকার এবং সংসদ নেতা- একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। দু’বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি (যেকোনো একটি পদে) হতে পারবেন না।

কোনো সংসদ সদস্য মারা গেলে বা আসন শূন্য হলে ওই আসনে দলীয়ভাবে সংসদ সদস্য পূরণ করবেন। যদি নির্দলীয় বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর আসন শূন্য হয় তবে রাষ্ট্রপতি যে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারবেন। তবে উপজাতি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হলে সেটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার বিষয়। আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে উপনির্বাচনের ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়, আবার অর্থেরও ব্যয় আছে। টেকনোক্র্যাট কোটায় কেবিনেটে ৫ : ১ করা যায় কি? সরকারিভাবে কোনো নেতার জন্মদিন বা মৃত্যুদিবস পালন না করে দলীয়ভাবে পালনের জন্য অনুরোধ করছি। সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। কেননা, পুলিশের মতো যদি বিজিবির হাতে ছাত্র-জনতা খুন হতেন এবং তারা পুলিশের মতো কর্মবিরতি পালন করতেন তাহলে সীমান্তে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতো।

৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধন করে দলের বিপক্ষে ভোট বা কথা বলার সুযোগ এমপিদের দিতে হবে। রাজনৈতিক সমঝোতার প্রতিফলন কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দিতে হবে। স্পিকারকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেই। দেশের প্রতিটি নাগরিককে প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। কোনো নাগরিক যদি আয়-ব্যয়ের অসত্য তথ্য প্রদান করে তবে তার সম্পদ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থপাচার রোধে টাস্কফোর্স গঠন, স্বাধীন দুদক, জনবান্ধব পুলিশ কমিশন, ইসিসহ সব সাংবিধানিক পদসমূহে নির্দলীয় নিরপেক্ষ যোগ্য ও সৎ মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে।

স্বাধীন সার্বভৌম দেশে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি অপ্রয়োজনীয়। তারা নিজস্ব ব্যানারে থাকতে পারবে, কোন দলীয় ব্যানারে নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিটি আসনে দলীয় মনোনয়নের আগে তাদের ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা কর্তব্য, এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চা অবশ্য তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বিগত ১৫-১৬ বছরের ইতিহাস এমন দুর্ভাগ্যজনকভাবে চলে গিয়েছিল যে, দুঃখের সাথে লিখছিÑ ‘সাবেক তিনজন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেও অবমাননার অভিযোগ রয়েছে। অবমাননা বলতে আইনগত কর্তৃত্ব বহিভর্‚তভাবে রায় দেয়ার অভিযোগ। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী ৮৪ বছরের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের ভাষণের সবটুকুই চমৎকার। তিনি বলেন, ‘আমরা সংস্কার চাই। আমাদের একান্ত অনুরোধ, আমাদের ওপর যে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন, সেই দায়িত্ব দিয়ে আপনারা দর্শকের গ্যালারিতে চলে যাবেন না। আপনারা আমাদের সাথে থাকুন। আমরা একসাথে সংস্কার করব। এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। আপনারা নিজ নিজ জগতে সংস্কার আনুন।’ আমি অতি সাধারণ এক নাগরিক, আমার মনের ভাবনাগুলো লিখে শেয়ার করতেই পারি, তাই লিখেছি।

আমাদের সবাইকে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজ এখনই করতে হবে। পরিবার, প্রিয়জন বা সন্তান হারানোর ওই আহত-নিহতদের নিজেদের আপনজন ভেবে ছোটখাটো মতভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশপ্রেম চিরতরে অ¤øান আর অটুট থাকুক, যেন আজীবন দ্বিতীয় স্বাধীনতা বা বিপ্লবের চেতনা হারিয়ে না যায়। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ হোক, সবার জীবন ও মরণের বাংলাদেশ। কার্যকর সংস্কারের সাথে সাথেই এগিয়ে আসুক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
kaisardinajpur@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement