পর্যবেক্ষণ : ভিওএকে ড. ইউনূসের একান্ত সাক্ষাৎকার
- সাইফুল খান
- ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০১
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভয়েজ অব আমেরিকাকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি প্রায় ১৮ মিনিট দীর্ঘ। তিনি জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধান হিসেবে অংশগ্রহণ করার পরে এবং দেশে ফেরার আগে সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের এই অধিবেশনটাকে ইউনূসময় বললে খুব একটা ভুল হবে না। তিনি ছিলেন ছোট দেশের বড় ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীর সবাই তাকে আগেই চেনেন। এছাড়া এই মুহূর্তে তিনি বিপ্লবী এক বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে ধাবমান সর্বোপরি বৈষম্যবিরোধী এক নয়া বাংলাদেশের তিনি প্রধান। তাই তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সময়কে তিনি খুবই গুরুত্বের সাথে কাজে লাগিয়েছেন। প্রতিদিনই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন।
ভয়েজ আমেরিকার সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক বিষয় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। যদিও ভয়েজ অব আমেরিকার প্রশ্নের ভেতর দিয়ে তাকে ম্লান করার চেষ্টা হয়েছে সূক্ষ্মভাবে। তবে তা হালে পানি পায়নি। বরং উত্তরের তীব্রতায় উপস্থাপকের চেহারা কিছুক্ষণের জন্য হলেও গো-বেচারা ধরনের হয়ে গিয়েছিল।
সাক্ষাৎকারে তাকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ও স্থির দেখাচ্ছিল। যথেষ্ট স্পষ্টভাষায় সাবলীল উত্তর দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অবস্থান,পরিকল্পনা ও কার্যক্রম অনেকটাই পরিষ্কার করেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভয়েজ অব আমেরিকার প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আহমেদ।
পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ নিজে মুক্তিযুদ্ধের যে বয়ান তৈরি করেছে। ওই নিজস্ব বয়ানের উপর দাঁড়িয়ে আনিস সরকারপ্রধানকে প্রশ্নগুলো করেছেন বলেই মনে হয়েছে। মনোযোগ দিয়ে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে। পুরো ১৮ মিনিটে গণঅভ্যুত্থানের মর্যাদা, গণমানুষের আত্মত্যাগ, পুলিশ-ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের পৈশাচিক নির্মমতার ব্যাপার তিনি ছিলেন নির্বিকার। এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি আনিস।
১. ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে কেন এত তাগাদা দিয়ে ফ্রান্স থেকে উড়িয়ে আনলেন বিপ্লবী ছাত্র-জনতা?
২. কেন তাকে এত রক্ত এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্ব হাতে তুলে দেয়া হলো?
৩. কেন বাংলাদেশের ছাত্র জনতা এতটা বিশ্বাস করে এই সম্মান দিলো?
৪.কেন আওয়ামী লীগ সরকার শ্রীলঙ্কার সরকারের মতো পালিয়ে গেল?
৫. কেন আফগানিস্তানের প্রভুদের মতো নিজেরা পালিয়ে গেল, কিন্তু সমর্থক নেতাকর্মীদের ফেলে গেল?
-এসব প্রশ্ন নেই!
প্রশ্ন নেই, কোন জাদুতে এত আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস পেলেন । কেন মি. বাইডেন নির্ধারিত ১৫ মিনিটের সাইড লাইন মিটিংয়ে প্রটোকল ভেঙে দ্বিগুণ সময় ৩০ মিনিট দিলেন।
জাতি আশা করেছিল, ভয়েজ অব আমেরিকা এই সব সুন্দর সুন্দর ঘটনা ও গল্পগুলো প্রফেসর ইউনুসের মুখ থেকে শুনবে, জাতিকে শোনাবে। অন্তত ভয়েজ অব আমেরিকা এই কাজটি করবে। তা হয়নি। বরং জাতিকে হতাশ করে তারা জাতির এই প্রিয় নেতাকে কিছুটা বিব্রত করেছে।
তবে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ৩২ নম্বর বাড়ি কেন বিনষ্ট, শেখ মুজিবের মূর্তি ধ্বংস কেন? এই প্রশ্নগুলো ছিল। নোবেল বিজয়ী জনাব ইউনুস এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অসাধারণভাবে। তিনি জনআকাঙ্ক্ষার বিক্ষুব্ধ বহিঃপ্রকাশের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ছাত্র-জনতা বলছে, তারা রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছে। এভিরিথিং ইজ গন। অতীতের আবর্জনা সব মুছে ফেলতে চায় নয়া বাংলাদেশ।
আওয়ামী বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে তিনি প্রশ্ন করেছেন। জনাব ইউনুস এর উত্তরে রাষ্ট্রের মৌলিক কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত রাগ-অনুরাগকে রাষ্ট্রের উপরে চাপানো যে অন্যায় সেটাই বুঝিয়ে দেন। কেউ অন্যায় করলে বিচার হবেই। সেটা সে যখনই করুক। কিন্তু ইতিহাসকে নিজের বয়ানে নির্মাণসাপেক্ষে সুবিধামত শত্রু-মিত্র তৈরি করে বিচার করার ফ্যাসিবাদী আওয়ামী আচরণ করার সুযোগ নতুন বাংলাদেশে থাকবে না। অন্যায় করলে বিচার হবেই। তার বক্তব্যে আইনের শাসনের উপর জোর দিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। যা নয়া বাংলাদেশের কাম্য। তিনি উপস্থাপককে স্মরণ করিয়ে দেন বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট মাসে পৃথিবী কাঁপানো ঘটনা ঘটে গেছে। বহু প্রাণের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে। সে বিষয়ে প্রশ্ন কাম্য ছিলো কিন্তু উপস্থাপক সেটা এড়িয়ে গেছেন।
পাকিস্তানের সাথে নতুন সরকারের সম্পর্কন্নোয়নের প্রচেষ্টাকে আলাদা করে দেখানো এবং সম্পর্কন্নোয়নের ক্ষেত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের চালানো গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়টির গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এখানে জনাব ইউনুস সততার সাথে তার অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, সার্ক নিয়ে তিনি কাজ করতে চান। যেখানে সার্কভুক্ত সবার সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে। উদাহরণ হিসেবে দেশগুলোর নাম উল্লেখ করেন। তাছাড়া সার্কের সহযোগী দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকবে অন্যান্য সহযোগী দেশের মতো।
ভারতের সাথে সম্পর্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। উত্তরে ভারতের সাথে উষ্ণ সম্পর্কের কথা বলেন জনাব প্রফেসর। তিনি উল্লেখ করেন ভারতেরও আমাদের দরকার,আমাদেরও ভারতকে দরকার। সেজন্য উভয়ই সম্পর্কন্নোয়নে এগিয়ে আসতে হবে। তবে ভারত কর্তৃক অনাকাঙ্ক্ষিত সীমান্তহত্যা যে কষ্ট দেয় সেটাও তিনি মনে করিয়ে দেন।
গণ-আন্দোলনের মুখে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দেন। পৃথিবীর যেখানেই তিনি থাকুক আইনানুগভাবে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
সংস্কার ও সরকারের মেয়াদ ইস্যুতে করা প্রশ্নের উত্তরে তিনি (জনাব ইউনুস) তার সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন। বিশেষ করে সংস্কার কমিটির কাজ নিয়ে তিনি কথা বলেন। সংস্কার জনগনের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে হবে। এজন্য আগে সমস্যাগুলো চিন্হিত করাই প্রত্যেকটি সংস্কার কমিশনের কাজ। তারপর সেটা কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে সেটা সকলের অংশগ্রহণেই করা হবে।
পতিত স্বৈরাচার আমলে রাষ্ট্রের ভিতরে চলে আসা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতিকে সংস্কার করতে হবে। কমিশনগুলোর কাজ হচ্ছে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে আনা। ইতিমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠিত হলেও আরো কমিশন গঠিত হবে। এটা মোটামুটি পরিষ্কার, সংস্কার কমিশনের প্রধান কাজ হলো মন্ত্রনালয়ভিত্তিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারের জন্য আগে তুলে নিয়ে আসা।
সংবিধান সংস্কার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল কাঠামোকে এমনভাবে সংস্কার করা যাতে নতুন করে এই দেশে আর স্বৈরাচার তৈরি না হয়। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধুয়ে মুছে সাফসুরত করে ব্যবহার উপযোগী হলেই এই সরকার নির্বাচন দেবে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের আকাঙ্ক্ষিত সরকার গঠন হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আমার অভিমত হচ্ছে সাধারনত বিপ্লব বা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়টা থাকে খুবই নাজুক। কোন কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। সেই দিক বিবেচনায় দেশের পরিস্থিতি অনেক ভালো। এক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক সেনাপ্রধানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের এই ক্রান্তিকালে তিনি অসাধারণ দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে ইতিমধ্যেই গনমানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। দেশের ভিতরে বিভিন্ন সময়ে যে বিক্ষিপ্ত ছোট ছোট ঘটনা ঘটছে এই সবই স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া কর্মীদের কাজ। গনমানুষের আকাঙ্ক্ষার সরকারকে তারা ব্যর্থ করতে ষড়যন্ত্র করছে। আরো করবে। তবে সে বিষয়ে সরকার যথেষ্ট সজাগ আছে বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
লেখক : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা