০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১, ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বৈরাচারীর বুলেটে বিধ্বস্ত দেশ

- প্রতীকী ছবি

নীরবতা দুর্বলতা নয়। শান্তিপ্রিয় মানুষেরা নীরব থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। অনেক বিষয় বুঝেও ঝামেলা এড়াতে সরে থাকেন। এ শ্রেণীর মানুষের প্রতিবাদের মাধ্যমই হলো নীরবতা। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার মানুষের এ নীরবতাকে দুর্বলতা মনে করে তার স্বৈরাচারী আচরণ আরো পাকাপোক্ত করেছে। মানুষের নীরবতাকে পুঁজি করে দেশের মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়েছে। সেই নিপীড়নের যে বীভৎস রূপ আজ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে তা সহ্য করা কঠিন। ’৭১-এ এ দেশের মানুষের মৃতদেহ শকুনে ঠুকরে খেয়েছে। আর এ ’২৪-এ এসে জলজ্যান্ত মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার পর পৈশাচিক নৃশংসতায় আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের বেডে শত শত আহত মানুষ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাতরাচ্ছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, বিভিন্ন পেশার সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারীর বুলেটের আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ করে হাসপাতালের বেডে আহাজারি-রোনাজারি করছেন। হাজার হাজার পরিবার আজ প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তাদের উপার্জনক্ষম মানুষের হত্যা ও পঙ্গুত্বের কারণে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পলায়নের পর থেকে তার যত অপকর্মের সাক্ষী এ বাংলার মানুষ হয়েছে সেটা বর্ণনা করাও খুবই কঠিন। এমন বীভৎস হত্যাযজ্ঞ কোনো মানুষের দ্বারা বাংলার ইতিহাসে এ প্রথম। আমরা হিটলারের জীবনী পড়েছি। হিটলার তার জীবদ্দশায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। তার তুলনায় ক্ষুদ্র আয়তনের এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞের আনুপাতিক হার অনেক বেশি। এমন সব অপকর্ম ঘটানো হয়েছে যেটা এ বাংলার মানুষের চিন্তাশক্তির অনেক বাইরে। একজন স্বাভাবিক মানুষ কখনো তার ভাবনায় এমন দুর্বিষহ ঘটনার কল্পনাও আনতে পারবেন না। বুকে, পায়ে, মাথায়, মুখে অস্ত্র বাধিয়ে গুলি করা হয়েছে রাউন্ডের পর রাউন্ড। যে নির্মমতা আবু জেহেলের নির্মমতাকেও হার মানানোর মতো। বিভিন্ন সময়ে হাসিনা সরকার টিভি-মিডিয়াতে এসে যে কান্নাকাটি করে বুক ভাসাতেন, তাতে আমরা অনেকেই কনফিউজড হয়ে যেতাম। তার কান্না দেখে মনে হতো আহারে কী মমতাময়ী মাতা পেয়েছে এ বাংলার মানুষ। কিন্তু এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, হাসিনার সেই কান্নাই ছিল ইংরেজিতে যাকে বলে ক্রোকোডাইলস টিয়ার্স এবং বাংলায় কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ।

৫ আগস্টের আগে ফেসবুক চালাতে ভয় করত। না জানি কখন কোন পোস্টের কারণে অপরাধ হয়ে যায়, চাকরি-বাকরি, এমনকি জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়! আর এখন ভয় করে ফেসবুকের ওয়াল স্ক্রল করতে। সহ্য ক্ষমতার বাইরের অনেক ঘটনা সামনে এসে পড়ে। কারো মাথার খুলির ৪৫% বুলেটে উড়ে গেছে। কারো বা নাক, মুখ-চোখ এক হয়ে গেছে খুনির বুলেটে। কলিজা কেঁপে ওঠে সে স্থির চিত্রগুলো চোখের সামনে এলে।

যমুনা টিভির নিউজে বলা হয়, ১৯ জুলাই ইমার্জেন্সি, আইসিইউ, সাধারণ ওয়ার্ড সবখানেই ছিল গুলিতে আহত আন্দোলনকারীদের ভিড়। মেঝেতেও জায়গা না হওয়ায় সিঁড়িতে জায়গা দেয়া হয় অনেককে। কারো গায়ে গুলি ১০টি, কারো ১৫-২০টি, কারো বা চোখের ভেতর অসংখ্য ছররা গুলি। একটা মানুষের শরীরে আর একটা মানুষ কিভাবে ১০-১৫, এমনকি ২০টা পর্যন্ত গুলি চালাতে পারে ভাবা যায় না। কতটা অমানুষ হলে এটা সম্ভব আমরা জানি না।

বিবিসির এক তথ্যে বলা হয়েছে, ১৯ জুলাই ঢাকার উত্তরায় পুলিশের গুলিতে আহত হন কলেজ শিক্ষার্থী রাইসুল রহমান রাতুল। পুলিশ তার পেটে বন্ধুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে গুলির বিস্ফোরণে রাতুলের ভুঁড়ি বেরিয়ে যায়।

মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্য মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৭৫ জন নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। ১২টি জাতীয় দৈনিক, এইচআরএসএসের তথ্য অনুসন্ধানী ইউনিট ও সারা দেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, নিহতদের মধ্যে ৭৭ শতাংশই গুলিতে মারা গেছেন। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। ’৭১-এ পাক হানাদার বাহিনী দীর্ঘ ৯ মাসে এ দেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে শহীদ করেছিল আর ২০২৪-এ দেশেরই স্বৈরাচারীর এক মাসে ৩০ হাজার মানুষকে তাদেরই টাকায় কেনা গুলিতে জীবন দিতে হবে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘মোট ৭৭২ জনের মৃত্যুর ধরন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৯৯ জন বা ৭৭ শতাংশ গুলিতে নিহত হয়েছেন। ৬১ জন (৮ শতাংশ) অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ৮৫ জনকে (১১ শতাংশ) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অন্যান্য কারণে মারা গেছেন ২৭ জন (৪ শতাংশ)।’ এইচআরএসএস জানিয়েছে, ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩২৭ জন এবং ৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (অনেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যান) ৫৪৮ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৭৭ শতাংশ গুলিতে মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী, এ হার ৫২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে।

এটা তো শুধু ২০২৪-এর একাংশের পরিসংখ্যান। তাহলে এ ১৭ বছর যে নৃশংসতা চালানো হয়ে এ দেশের মানুষদের ওপর সেটার হিসাব মেলানো খুবই কঠিন। গত ৫ বছরে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আমার নিজের ফোনই চেক করা হয়েছে শ’খানেক বার। গত ১৭ বছরে এ দেশের বিবেকবানদের বিবেকশূন্য নাদান হিসেবে জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়। বাকরুদ্ধ করতে যা যা করা যায় তার থেকেও অনেক বেশি করেছে এ ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার অতিউৎসাহী দোসররা। এ ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকার তার আমলে হাজার হাজার মানুষকে খুনের পাশাপাশি বিরোধী মত দমনে গুম করেছেন হাজারে হাজার। মানুষের এ চরম বঞ্চনার প্রতিফলন ঘটেছে আগস্টের ৫ তারিখে। ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতিহিংসার আগুনে এ ১৫ বছর যে পরিবারগুলো নানাভাবে অত্যাচারিত হয়েছে সেই পরিবারগুলোকে খুঁজে বের করে তাদের পাশে দাঁড়ানোরও সুযোগ আছে।

যদি এসব ত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন আমরা না করতে পারি তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের নিয়ে লজ্জাবোধ করবে। মানুষ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলবে। ’২৪-এর সব শহীদের আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয় করে রাখতে যা যা করা প্রয়োজন সেটা করা উচিত। বিষয়টি সব রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement