২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আগামীর রাজনীতি প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

- প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্র শাসনের সাথে সরকারদলীয় রাজনৈতিক আদর্শের একটা সুন্দর নিবেদন আছে এবং তা খুব গভীর ও জোরালো। প্রত্যেকটি ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে রাজনৈতিক দলের আদর্শ জনগণের ও সমাজের প্রত্যেকটি শাখার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস্তবায়ন করতে না পারলে হয়তো ক্ষমতা চিরদিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী সরকার তাই করতে চেষ্টা করেছে। তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার বয়ানের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল যে, ব্যক্তির মন থেকে সমাজ, দেশ থেকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরের সব ক্ষেত্রে আওয়ামী আদর্শের ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠা করা। সত্য সুন্দর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লুণ্ঠিত করে নিজেদের মনগড়া ও বিকৃত চেতনারস্বরূপ হাজির করে, জনগণের মুখে ও মনে গেলাসে গেলাসে শরবতের মতো করে কিভাবে গেলানো যায়, তার প্রয়াশে গভীর ধ্যানে মত্ত ছিল। প্রতিদিন বিরিয়ানি খেতে কার ভালো লাগে? মাঝে মধ্যে শরীরে শুঁটকি আলুভর্তারও যে প্রয়োজন আছে- ক্ষমতায় বসে তারা জনগণের সে প্রয়োজনবোধটুকু বেমালুম ভুলতে শুরু করেছিল। এমন কোনো সেক্টর বা খাত নেই, এমন কোনো আলয় বাকি রাখেনি, যেখানে মুজিববাদ ও তাদের আওয়ামী বিকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। এই একটামাত্র উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য তারা কী করেনি? কী ঘটায়নি দেশে? মেকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন, ‘লক্ষ্য সঠিক হলে পন্থা বেঠিক হোক, তাতে কিছু যায় আসে না । রাজন্যকে সিংহের মতো বলবান, শৃগালের মতো ধূর্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ষোলো শতকের চিন্তাবিদ মেকিয়াভেলি আজ পৃথিবীব্যাপী চিরনিন্দিত। আওয়ামী রেজিম সিংহ ও শৃগাল নীতির অনুসরণ করেছে।

ইতিহাসবেত্তা আবুল ফজল বাঙলাকে ‘হাউজ অব টার্বুলেন্স’ অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল জনতার আবাসভ‚মি বলেছেন। কবিত্ব করে শাহ নেয়ামতউল্লাহ বলেছেন, ‘এখানে হয়তো কেউ বাঘের মুখে পড়বে, না হয় পিষ্ট হবে কুমিরের চোয়ালে’। পর্তুগিজ নাবিক টম পিয়ারসন বলেছেন, ‘এই অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাসঘাতক’। মেকলে আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, ‘মহিষের নিকট থাকে তার শিং, মৌমাছির কাছে যেমন তার হুল, গ্রিক সঙ্গীতে নারীর যেমন সৌন্দর্য, বাঙালির নিকট তেমনি প্রবঞ্চনা এবং কপটতা’ (সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতি- ড. এমাজউদ্দীন) । বিশ্বাসঘাতক, উচ্ছৃঙ্খল, শৃগাল, কুমিরের চোয়াল, বাঘের মুখ, প্রবঞ্চনা, কপটতার মতো বিশ্রী ও সৌন্দর্যহীন এই বিশেষণগুলো আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিম না দেখলে হয়তো পূর্বেকার বাঙালির জীবনে যে এরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে না। আলোর নিয়মিত প্রতিফলনের মতো বর্তমানকার আওয়ামীর বয়ান ও চরিত্রে ইতিহাসের সেই ধারাবাহিকতার প্রতিফলন ঘটেছে।

কল্যাণমুখী সুস্থ ধারার রাজনীতি আলোকে কাছে টানে, অন্ধকারকে দূরে ঠেলে। দূরকে কাছে টানে। পরকে আপন করে। শত্রুকে মিত্র করে ঐক্যের সেতুবন্ধ গড়ে তোলে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানায় না। শত্রু সমতুল্য চিন্তা করে তাদের ইজম বা আইডলজিকে ঘায়েল করার চেষ্টারত থাকে না। ক্ষমতাসীন দলের আদর্শের বাইরে প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক দলকে একেবারে বিলীন করে দিতে চায় না। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে উর্দুভাষী পাকিস্তানকে ধরে মারার জন্য যেভাবে স্লোগান তুলেছিল, তা এখনকার সুস্থ রাজনীতিতে কাম্য নয়। রেসকোর্স ময়দানে জমায়েতের পর সম্মিলন শেষ করে যাওয়ার পথে স্বাধীন বাংলার মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিবাহিনী ও সংগঠকরা স্লোগান তুলেছিল, ‘একটা একটা পাকিস্তানি ধরো, ধইরা ধইরা জবাই করো’। তখন তাদের জবাই করার পেছনে সম্ভাব্য যথেষ্ট কারণ থাকলেও ফের ৫৪ বছর পর এই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামীরাই গলায় ¯স্লোগান তুলেছে- ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’। কত নির্মম ও প্রহসনমূলক স্লোগান তারা বুকে ধারণ করত। জামায়াত-শিবির রাজনীতিকে এত ঘায়েল করে প্রকাশ্যে রাজনীতির মাঠে জবাই করার সাহস কোন সংবিধানে পায়?

ধজভঙ্গ সব সংশয় ও চিন্তাফিকির বাদ দিয়ে, শরতের শুভ্র কাশফুলের মতো হৃদয় উজাড় করে, বিবেকবান সেজে মনের ভেতর থেকে নিঃশব্দে ভেবে খেয়াল করে দেখুন, শেখ হাসিনার গত রেজিমটা কতটা ভয়ঙ্কর ও প্রলয়ঙ্করী উল্কা হলে একটা মানুষ তার জীবনের রাজনৈতিক আইডোলজি নিজ দেশে, নিজ ক্যাম্পাসে প্রকাশ করতে সাহসটুকু পর্যন্ত পায়নি? দুই-চার বছর একসাথে একই রুমে বসবাসের পরও কোনো বন্ধু-ব্যাচমেটরা রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে অণু-পরমাণুসম জানার ফুরসতের দূরে থাক, কুসুম-গরম পানির আঁচ বা অনুমানটুকু পর্যন্ত করতে পারেনি? আমাদের সমাজব্যবস্থা পুরাণে বর্ণিত রাক্ষসী সমাজব্যবস্থার সাথে কতটা মিলে যায়- সূক্ষ্মতার সাথে একটু ভাবুন। এসব করেছে কেবল ক্ষমতার জন্য। ক্ষমতাকে একচেটিয়া অপব্যবহার করার জন্য। ক্ষমতার মসনদ ও রাজ্য ধরে রাখার জন্য।

ফ্যাসিবাদ কোনো নীতিই মানে না। কোনো স্বৈরাচারের নির্দিষ্ট কোনো আচার থাকে না। যে ফ্যাসিবাদের কোনো নীতি নেই, আচার নেই, তার আবার ‘রাজার নীতি’ কী করে থাকবে? ফ্যাসিবাদ হলো নরপিশাচদের মতো রাক্ষস, অর্থপিপাসুদের মতো ভক্ষক। ফ্যাসিবাদ বুঝে শুধু ক্ষমতা, বিনিময়ে কাগজি অর্থ নয়, চায় মানুষের ঈষৎ রক্ত। লাল রক্ত। রক্তপানে ফ্যাসিস্ট শাসক চায় ক্ষমতার গতি বাড়াতে, স্রোতের গতিতে চলতে এবং ক্ষমতার পালকে ভর করে আকাশে উড়তে। এই রকম জঘন্যতম একটা পরিবেশের পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা কোনো স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাজনীতির পক্ষে কোন অভিমত ব্যক্ত করবে? প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় চলে আসে ছাত্ররাজনীতির কথা। ফ্যাসিস্ট রেজিমে যে মানুষটা, যে ছাত্রটা চার দিকে দেখে আসছে মানুষ খুন, গুম, হত্যা, আবরার হত্যা, আয়নাঘরের মতো মরণস্বাদের ঘর, সে কি রাজনীতির প্রতি বিমুখ না হয়ে পারে? যে ছাত্রটা গণতান্ত্রিক শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি করার দরুন তাকে আবরারের মতো হত্যার শিকার হতে হয়, সে কখনো শিবির রাজনীতি প্রকাশ্যে করতে যাবে? ছাত্রদলকেই তো এতদিন কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে? এই যে একটা মৃত্যুভয় তৃণমূল পর্যন্ত জনগণের মনে গেঁথে দেয়া হয়, এটাই ফ্যাসিবাদ। এটাই হিটলারের নাৎসিবাদ, মুসোলিনির শাসন।

রাজনীতি ছাড়া রাষ্ট্রনীতির মুক্তি নেই। জাতিরাষ্ট্রের উপস্থিতি নেই। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফারাজ থেকে শুরু করে খেটে-খাওয়া দিনমজুর, শিক্ষক, ড্রাইভার, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, ডান-বাম আপামর সবার মিলিত চেষ্টা ও হাজার প্রাণের বিনিময়ে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। রক্তপিশাচ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট থেকে দেশকে উদ্ধার করা হয়েছে। নতুন এক বাংলাদেশের উদয় হয়েছে। নতুন দেশে ফের ফ্যাসিবাদের বীজ বপন বা কায়েম যেন না হয় সে দিকে পূর্ণ দৃষ্টিনিবদ্ধ রাখতে হবে। হরিণের মতো কান সজাগ রাখতে হবে। আমাদের রাজনীতিকে ফের ফ্যাসিবাদের হাতে তুলে দেয়া যাবে না।

আমার বিশ্বাস এবং এ কথা সত্য যে, এতকিছু করার পরও আওয়ামী রাজনীতি দেশে আবার ফিরবে, রাজনীতির মাঠে আবার তারা নিজস্ব মতাদর্শে রাজনীতি করবে- এই সুযোগটা রাষ্ট্রকেই তাদের দিতে হবে। রাষ্ট্র আওয়ামীকে যা দেবে না, তা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকেও তা দেবে না। রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদের ছিটেফোঁটা একেবারে উপড়ে ফেলতে হবে। স্বৈরাচারের শাখা-প্রশাখা রাখতে দেয়া যাবে না। ফলে, সুষ্ঠু ধারার বিভিন্ন রাজনীতির দলের অংশগ্রহণমূলক সহবস্থান দেশে থাকবে। কেউ যদি চিন্তা করে আওয়ামীকে একেবারে বিলীন করে দিয়ে নতুন বাংলাদেশ কায়েম করে ফেলবে, তা হয়তো কখনো সম্ভব নয়। যে আওয়ামী সরকার জামায়াত-শিবিরকে প্রকাশ্যে জবাই করার সরাসরি স্লোগান দিয়েছে, তবুও জামায়াত রাজনীতি থেকে তারা বিলীন করতে পারেনি।

বিএনপি-ছাত্রদলের রাজনীতিকে মাঠ থেকে একেবারে নিষ্ক্রিয় করতে পারেনি। যদি ফের আওয়ামীর সাথে তা করা হয়, তা হবে দ্বিতীয় স্বৈরাচারের দ্বার উন্মুক্তকরণ। পুরো আওয়ামী কওমকে বাদ দিয়ে দেশকে সামনে নেয়া অসম্ভব। কাগজে কলমে খাতায় স্বাক্ষর করে আওয়ামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে কি আর আওয়ামী মতাদর্শ মগজ থেকে একেবারে বিলীন করা সম্ভব? কাগজে বিলীন হলে মগজে থেকে যাবে। কোনো মতাদর্শকেই একেবারে বিলীন করা সম্ভব না, বিলীন করা উচিত হবে না। যে আওয়ামী রাজনীতি বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাকেও বাদ দেয়া সম্ভব নয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিজয়ের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কাজ চলছে। দেশের চালিকাময় সর্বশক্তি ‘সংবিধান’ প্রশ্নে নানা সংস্কার কাজ হাতে নিয়েছে ইতোমধ্যো। সংবিধান এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যেন, দ্বিতীয় কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে জনগণের ক্ষমতাকে খর্ব করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মতো কোনো কিছু কায়েম করতে না পারে। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আলাদা করতে হবে। দেশে যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে, সে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, এমন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ যেন সার্বভৌমেত্বের প্রতি বিশ্বাস রেখে স্বাধীনভাবে দেশের তরে কাজ করতে পারে এবং কোনো সরকারি দলের তাঁবেদারি না করতে হয়, সে আইনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে দেশের প্রশ্নে জনগণের রাজনীতির উপস্থিতিতে জবাবদিহিতার আওয়াতায় আনতে হবে।

যে রাজনীতিতে জয়ী হয় কোনো দল, সে রাজনীতি জনগণের রাজনীতি নয়। যে রাজনীতিতে ক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা ক্ষমতার স্থিতিশীলতা আনয়নের চেষ্টা করে সে রাজনীতি জনগণের হতে পারে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে দলমত নির্বেশেষে সবার। দেশের সংবিধান হবে সব জনগণের আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক। সব দলের রাজনৈতিক আদর্শের সহাবস্থান থাকবে সংসদে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গণতান্ত্রিক আদলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি অনন্য ও উন্নত দেশের রোলমডেলের উদাহরণ হবে- এই কামনাই করি।


আরো সংবাদ



premium cement