২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শান্তি, স্বকীয়তা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে উদ্বুদ্ধ করে ইসলাম

- প্রতীকী ছবি

ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি, আত্মসমর্পণ যা মূলত মানুষের কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পৌঁছে দেয় শান্তির বার্তা। মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষ ও জিন জাতিকে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র হিসেবে দুনিয়ায় জীবন পরিচালনায় সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া ছিল দ্বীন ইসলাম আগমনের মূল উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় কুরআন সত্য-মিথ্যার ফয়সালা এবং এটা উপহাস নয়।’ (সূরা : আত্ব-তারিক্ব ১৩) হানাহানি, দ্ব›দ্ব-সংঘাত কিংবা অরাজকতা সৃষ্টির ন্যূনতম কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। তাই ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়। এটি মূলত পূর্ণাঙ্গ এক জীবনব্যবস্থা।

মহান আল্লাহ আল কুরআনে বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম।’ (সূরা : মায়েদা ৩)। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একজন মানুষের দুনিয়ার জীবন পরিচালনা কেমন হবে তার পুরো দিকনির্দেশনা আল্লাহ মানবজাতিকে দিয়েছেন। তার পুরো বাস্তবায়ন হাতে-কলমে দেখিয়েছেন নবী-রাসূলদের মাধ্যমে। আমাদের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দিয়েছেন হজরত মুহাম্মাদ সা:।

জাহিলিয়াতের যুগে পুরো আরব যখন অশান্তির দাবানলের লেলিহান শিখায় প্রজ্বলিত ঠিক তখন আল্লাহ শান্তির বার্তাবাহক আখেরি নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-কে আরবে প্রেরণ করেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। আরবের ভাষা আরবি হওয়ায় মানুষের বোধগম্য হওয়ার সুবিধার্থে আল-কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল করা হয়। নবী করিম সা:-এর প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা : আম্বিয়া ১০৭)। মূলত নবী সা:-এর আগমনী বার্তা ছিল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পুরো মানব ও জিন জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের এক প্রাণপ্রদীপরূপে। তাঁর নবুয়্যত ও রিসালাত কে মানল, কে মানল না এটা কারো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ও স্বাধীনতা। যা নিয়ে জোর-জবরদস্তি কিংবা বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ সবার জাতীয়তা বাংলাদেশী। কিন্তু ধর্ম আলাদা আলাদা। স্বাধীন দেশে যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে। কেউ কারো ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কোনো কটূক্তি করবে না যা সম্পূর্ণরূপে আমাদের সংবিধানসম্মত। প্রত্যেকে যে যার ধর্মীয় স্বকীয়তা ও বিধি-নিষেধগুলো মেনে চলবে। তাই ধর্ম যার যার, উপাসনা ও উৎসবও তার তার। এখানে থাকবে না কোনো জোর-জবরদস্তি। একটি অনুষ্ঠানে সবাই যদি অতিথি আখ্যায়িত হয় তবে কে হবে মেহমান আর কেইবা হবে মেজবান। একেক ধর্মের রীতি রেওয়াজ একেক রকমের। এটা মূলত ধর্মীয় স্বকীয়তা।

পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ দেশের নাগরিক। তারা তাদের সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাদি ও নাগরিক অধিকার রীতিমতো ভোগ করবে। ধর্মীয় অনুশাসনগুলোও যার যার মতো করে মেনে চলবে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপাসনা-পর্বোত্তর আনন্দ উৎসবগুলোতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনকে দাওয়াত করবে সহজাত সৌজন্যবোধ থেকে। তবে কে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবে আর কে করবে না এটা সম্পূর্ণরূপে কারো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। নিজের ধর্মীয় অনুশাসন এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ালে সেটা বিবেচনার দায়িত্ব মেহমানের ওপর বর্তায়। মেজবান অথবা অন্য কারো তরফ থেকে কোনো ধরনের জোর-জবরদস্তি আরোপ বা ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ নামের মনগড়া কোনো ফতোয়াদানের সুযোগ ইসলামে নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের জীবনব্যবস্থা তোমাদের জন্য আমার জীবননীতি আমার জন্য।’ (সূরা : কাফিরুন ৬) তবে মেহমানের অপারগতা প্রকাশের ভাষা হবে বিনয়ের সাথে মেজবানের প্রতি যথার্থ সম্মান বজায় রেখে যা আমাদের উপহার দেবে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বাস্তব প্রতিবিম্ব। অন্যথায় কেউ যদি মনগড়া কোনো ফর্মুলার মাধ্যমে নতুন কোনো মতাদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তবে সেটা হবে অজ্ঞতা। উপরন্তু, সংকরায়িত এ তত্ত্ব জন্ম দেবে এক অসুস্থ পরিবেশ; যেখানে সম্প্রদায়গুলো হারাবে নিজের ধর্মীয় স্বকীয়তা এবং তৈরি হবে নিত্যনৈমিত্তিক অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা যা ইসলামের মূল চেতনার পরিপন্থী এবং সাংঘর্ষিক।

যুগে যুগে সারা বিশ্বে ফেৎনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী ও সুবিধাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী এসেছে যারা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মনগড়া বহু মতবাদ সমাজে প্রচার করেছে এবং এখনো করে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো তাদের অন্তরের কথা নয় বরং লোক দেখানো কিংবা মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে মুখে আওড়ানো বুলি মাত্র, যার নেই কোনো শরিয়তসম্মত ভিত্তি বা অনুমোদন। কখনো রাজনীতির ময়দানে আবার কখনোবা কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে অবস্থান করে সব সম্প্রদায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মনোরঞ্জনের নিমিত্ত এগুলো করা হয় সম্পূর্ণরূপে নিজেদের স্বার্থান্বেষী চিন্তা-ভাবনা থেকে যা বস্তুতপক্ষে গর্হিত একটি অপরাধ। (তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আর আমার দ্বীন আমার।’ (সূরা : কাফিরুন ৬)

অতএব, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতেও আমরা সব সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সম্মান করে চলব, যেখানে যে যার ধর্মীয় উপাসনা ও উৎসবগুলো নিজ নিজ নিয়মমাফিক পালন করবে। কেউ কারো প্রতি কোনো হেয় অথবা বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করবে না যা দ্বীন-ইসলাম এবং আমাদের সংবিধানসম্মত। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় স্বকীয়তা মেনে চলবে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান। আল্লাহ মুসলিমদের সৃষ্টি করেছেন মধ্যপন্থী এক জাতি হিসেবে যেখানে কোনো ধরনের চরম পন্থার সুযোগ আদৌ নেই। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অতীতে এ ধরনের বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে অনেক জাতি, যার প্রমাণ মেলে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে। তাই মন্দিরে হামলা বহুদূর, মূর্তিকে গালি দেয়া পর্যন্ত ইসলামে নিষেধ। এটাই ইসলামের সৌন্দর্য, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এভাবে দ্বীন-ইসলাম জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহাবস্থান, সহানুভূতি ও সবরের দীক্ষা দেয়। নিম্নের উদ্ধৃতিগুলো তার প্রমাণ বহন করে।

(১) ‘হে ঈমানদারগণ, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেব-দেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে।’ (সূরা : আন-আম ১০৮)

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement