২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪ আশ্বিন ১৪৩১, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নতুন বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের প্রত্যাশা

- প্রতীকী ছবি

২৫ সেপ্টেম্বর পালিত হলো বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য, এ পেশায় কর্মরত ব্যক্তিগণ বিশ্বময় স্বাস্থ্যসেবায় যে বহুমাত্রিক অবদান রেখে আসছেন তার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ।

২০১০ সাল থেকে বিশ্বের ফার্মেসি পেশাজীবীরা সভা-সেমিনার, শোভাযাত্রা, রক্তদান কর্মসূচিসহ নানাবিধ বর্ণাঢ্য আয়োজন ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করে আসছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের-এফআইপি পক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল : Pharmacists : Meeting global health needs (ফার্মাসিস্টরা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যচাহিদা মেটাচ্ছেন)। এ প্রতিপাদ্যের উদ্দেশ্য হলো, বিশ্বজুড়ে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ফার্মেসি পেশা যে অবদান রাখছে তা সবাইকে জানানো এবং উদযাপন করা। এ ক্যাম্পেইন বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা উন্নততর করতে আমাদের আরো যেসব সম্ভাবনা রয়েছে তা তুলে ধরারও একটি সুযোগ।

বাংলাদেশে ফার্মেসি শিক্ষার সূচনা হয় ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগ খোলার মধ্য দিয়ে। এর প্রায় দু’দশকের বেশি সময় পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ফার্মেসি বিভাগ খোলা হয়। এর অল্প সময়ের ব্যবধানে সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হয়। বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ১৩টি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ৪-৫ বছর মেয়াদি ফার্মেসি শিক্ষা চালু রয়েছে, যারা গ্র্যাজুয়েট তথা ‘এ’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তৈরি করছে। এ ছাড়া ১৭টি সরকারি ও ৪১টি বেসরকারি ইনস্টিটিউট ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানের মাধ্যমে ‘বি’ ক্যাটাগরির ফার্মাসিস্ট তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল ও বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি যৌথভাবে ওষুধ ব্যবসায়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য একটি ত্রৈ-মাসিক ফার্মেসি সার্টিফিকেট রেজিস্ট্রেশন কোর্স পরিচালনা করছে। বর্তমানে দেশের ৫৫টি জেলায় কেমিস্ট সমিতির ৭৫টি কেন্দ্রে এ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে।

ফার্মেসি একটি বহুমাত্রিক পেশা। বিশ্বময় স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন আঙ্গিকে ফার্মাসিস্টরা অতুলনীয় ভ‚মিকা রাখছেন। ফার্মেসি কারিকুলামের উদ্দেশ্য- ওষুধের বিভিন্ন দিক ও আঙ্গিকের ওপর দক্ষ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জনবল তৈরি করা। এতদুদ্দেশ্যে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ৪ বছর মেয়াদি ব্যাচেলর কিংবা ৫ বছর মেয়াদি ফার্ম. ডি. (ডক্টর অব ফার্মেসি) কোর্স অফার করে। এ দীর্ঘ পরিক্রমায় ফার্মেসির একজন ছাত্রকে ওষুধের ব্যবহার ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি ওষুধের মূল ও সহায়ক উপাদান আহরণ/সংশ্লেষণ, বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে ট্যাবলেট/ক্যাপসুল ইত্যাদি প্রোডাক্ট তৈরি, মান নিয়ন্ত্রণ, সংরক্ষণ, বিপণন, বিতরণ, ওষুধ ব্যবহারকালে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণসহ ওষুধ সম্পর্কিত সব দিক ও আঙ্গিকের ওপর দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়।

ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্র ৩টি প্রধান ভাগে বিভক্ত : ১. কমিউনিটি/রিটেইল ফার্মেসি (ফার্মেসি শপ), ২. হাসপাতাল এবং ৩. ওষুধ শিল্প।
বৈশ্বিক পর্যায়ে মোটা দাগে বলা চলে, ৮০-৮৫ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট কমিউনিটি ও হসপিটাল ফার্মেসিতে পেশাগত সেবা দিয়ে থাকেন, যেখানে তারা ডাক্তার ও রোগীর মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেন। ওষুধ সম্পর্কে ডাক্তার ও রোগী উভয়কেই বিশেষজ্ঞ সেবা দেয়ার পাশাপাশি ওষুধের যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ও অপপ্রয়োগ রোধের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তারাই করেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট তৈরি হলেও নীতি-নির্ধারকদের মনোযোগের অভাব এবং একটি মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে এ অধিক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অংশগ্রহণ এখনো শূন্যের কোঠায়।

দেশে এ মুহূর্তে কিছু গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট স্ব-উদ্যোগে এবং কিছু বেসরকারি হাসপাতাল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্ববধানে ‘মডেল ফার্মেসি’ নামে কিছু রিটেইল/কমিউনিটি ফার্মেসি চালু করেছে। ওষুধ প্রশাসনও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের পরিচালনায় কিছু মডেল ফার্মেসির লাইসেন্স দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ‘সি’ গ্রেডের ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে ফার্মেসী পরিচালনার সুযোগ অবারিত রাখা হলে এবং ওষুধ ব্যবসায়ীরা যাতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগে উৎসাহিত/বাধ্য হন এমন কিছু নিয়ম-কানুন প্রণয়ন না করেন তাহলে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না। সরকারি হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ওষুধের বিষয় দেখাশোনার জন্য কিছু ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিছু নামিদামি বেসরকারি হাসপাতালও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবায় ফার্মাসিস্টদের ভ‚মিকার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে অগ্রণী ভ‚মিকা নিয়েছে।

তবে যতক্ষণ না আমরা জাতীয় স্বার্থে ও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রয়োজনে হাসপাতাল ও রিটেইল ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টদের যথোচিত ভ‚মিকা নিশ্চিতের গুরুত্ব তুলে ধরতে পারছি, ততক্ষণ ব্যাপক পরিসরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ও সংস্কারের যে আবহ তৈরি হয়েছে তার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য সেক্টরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ফার্মেসি পেশাজীবীরা সরকারি হাসপাতালে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের জন্য দীর্ঘকাল ধরে যে দাবি জানিয়ে আসছেন তা বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হলে সিভিল সার্ভিসে চিকিৎসকদের মতো ফার্মাসিস্টদের জন্যও একটি টেকনিক্যাল ক্যাডার সৃষ্টি করা জরুরি।

ফার্মেসি শপসমূহে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ নিশ্চিত করার পর্যায়ক্রমিক পরিকল্পনা বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে অবিলম্বে বড় বড় ফার্মেসি শপে একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট রাখা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব থাকবে। সরকারি পর্যায়ে যথাযথ পলিসি গ্রহণ করা হলে এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে দেশে হাসপাতাল ও ফার্মেসি শপে ওষুধসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা সম্ভব।

লেখক : সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement