২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
তিউনিসিয়ায় নির্বাচন

ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে চান কায়েস

- ছবি : সংগৃহীত

তিউনিসিয়ায় আরববসন্তের পর স্বৈরশাসক বেন আলির জমানা শেষ হয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও স্থায়ী রূপ পায়নি। দেশটাকে থাকা কঠিন রাজনৈতিক সঙ্কটের বাতাবরণে, নানা বিতর্কের মধ্যে আগামী ৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদের অধীনেই আরো একটি নির্বাচন হচ্ছে গুটিকয়েক প্রার্থী নিয়ে, বহুদলীয় কোনো অংশগ্রহণ ছাড়াই। কায়েস কার্যত আরববসন্ত-উত্তর আরেক স্বৈরশাসক হতে চলেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সেই ধারায় এই নির্বাচনে কায়েস সাইদ আবার প্রার্থী হয়েছেন এবং তার শাসনকাল প্রলম্বিত করতে চাইছেন। এটি এমন সময়ে ঘটছে যখন আরববসন্তের কথা মানুষ ভুলতে বসেছে।

আরববসন্তের সূচনা তিউনিসিয়ায় হলেও দেশটিতে আরববসন্তের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মিসরেও একই অবস্থা হয়েছে। দুই দেশেই দু’জন একনায়কের আবির্ভাব দেশ দু’টিকে গণতন্ত্রের বাতাবরণ থেকে আগের অবস্থানেই নিয়ে গেছে। তবে এটি প্রতিবিপ্লব হিসেবে আসেনি, এসেছে আরব বিপ্লব বা আরববসন্তকে সঠিকভাবে কার্যকর রূপ না দেয়ার কারণে। তিউনিসিয়ায় বর্তমানে কার্যকর বহুদলীয় রাজনীতি নেই। রয়েছে অর্থনৈতিক সঙ্কটসহ নানামুখী সঙ্কট। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, ষড়যন্ত্র- এসবের মূলে রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এই নির্বাচন সঙ্কট নিরসনে কোনো ভ‚মিকা রাখবে বলেও মনে করেন না তারা। প্রায় এক দশক আগে যে দেশটি ছিল ‘আরববসন্ত’ এর জনক, যেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ স্বৈরাচারের অবসানের জন্য সোচ্চার হয়েছিল, আজ সেই একই দেশ আবারো পুরোনো পথে ফিরছে। এক দিকে এখানকার মানুষ রুটি-রুজির জন্য চিন্তিত, অন্য দিকে এখানে রাষ্ট্রপতির অপতৎপরতা চলছেই।

তিউনিসিয়া উত্তর আফ্রিকার উপকূলে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এক কোটি দুই লাখ লোকের দেশ। দেশটির উত্তরে উর্বর সমভ‚মি ও দক্ষিণের শুষ্ক, উষ্ণ মরুময় অঞ্চলে ভাগ করেছে। এর উত্তরে ও পূর্বে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। এর পশ্চিমে আলজেরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্বে লিবিয়া। দেশটির ৪৫ শতাংশ জায়গা সাহারা মরুভ‚মিতে পড়েছে। সামরিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে উত্তর আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণে অভিলাষী বহু সভ্যতার সাথে তিউনিসিয়ার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ১৮৮১ সাল থেকে তিউনিসিয়া ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ ছিল। ১৯৫৬ সালে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। আধুনিক তিউনিসিয়ার স্থপতি হাবিব বোরগুইবা দেশটিকে স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেন এবং ৩০ বছর ধরে দেশটির রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। জাইন আল আবেদিন বেন আলি একটানা দুই যুগ দেশটাকে কঠিন হাতে শাসন করেন। স্বাধীনতার পর তিউনিসিয়া উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ইসলাম এখানকার রাষ্ট্রধর্ম; প্রায় সব তিউনিসীয় নাগরিক মুসলিম। কিন্তু সরকার ইসলামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। এই বাধা সত্ত্বেও আননাহদাসহ প্রধান প্রধান দলগুলো কাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের নাম ছিল জেসমিন বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে ১৪ জানুয়ারি ২০১১, ২৪ বছরের শাসক জাইন এল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে এবং তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। এরপর নির্বাচনে ইসলামপন্থী দলগুলো ভালো ফল করে। দেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল আননাহদার দু’জন প্রধানমন্ত্রী দেশ শাসন করেন। কিন্তু পরে রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বিরোধী অপর একটি জোট ও কয়েকজন স্বতন্ত্র এমপি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কায়েস সাইদ। আননাহদা ও বিরোধী অন্য দলগুলোর মধ্যে মারাত্মক অনৈক্যের সুযোগ নেন তিনি। ২০২১ সালে পুলিশি বর্বরতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। ২০২১ সালে জুলাইয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিশাম মেসিসি সরকারকে বরখাস্ত করে স্বঘোষিত অভ্যুত্থানের মাধ্যেমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এরপর তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড় ও বিচার বিভাগকে কোণঠাসা করে অবস্থান শক্ত করেন। সেই পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন আননাহদা পার্টির নেতা রশিদ ঘানুচি। রশিদ ঘানুচিসহ অনেকেই এখনো জেলে আছেন। এরপর তিনি ডিক্রি জারি করে দেশ শাসন অব্যাহত রাখেন। আননাহদাসহ বিভিন্ন দল রাস্তায় জনসমাবেশ আন্দোলন করলেও তাতে তিনি কান দেননি। অভ্যন্তরীণ কোনো কোনো পক্ষ তাকে সহযোগিতা করেছে। এরপর বিরোধী মতের তোয়াক্কা না করে তিনি সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্ট পদকে আরো শক্তিশালী করেন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া পার্লামেন্ট নির্বাচন দেন। এতে ভোটের হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। এখন কায়েস সাইদ নতুন করে মেন্ডেট নিয়ে তার ক্ষমতার সময়সীমা বাড়াতে চাইছেন। তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী কায়েসকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হতো। একপাক্ষিক শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়ে দেশটির অর্থনীতিতে। তিউনিসিয়ায় বর্তমানে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও দেশটির ১২ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে প্রায় চার মিলিয়ন নাগরিকই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। তিউনিসিয়ান সাংবাদিকদের ন্যাশনাল ইউনিয়নের মতে, ৬০ জনেরও বেশি সাংবাদিক, আইনজীবী এবং বিরোধীদলীয় নেতা কারাগারে বন্দী রয়েছেন।

কেমন হচ্ছে এবারের নির্বাচন? এই নির্বাচনে মাত্র তিনজন প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন। নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত তালিকায় থাকা তিন প্রার্থী হলেন আয়াচি জামেল, বর্তমান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ ও জোহাইর মাগাজাউই নামে সাবেক একজন সংসদ সদস্য। ১০ আগস্ট রয়টার্স জানায়, তিউনিসিয়ার নির্বাচন কমিশন প্রাথমিকভাবে ক্ষমতাসীন কায়েস সাইদসহ শুধু তিনজন প্রার্থীকে গ্রহণ করেছে। কমিশন বলেছে যে, তারা সাইদ ও পিপলস মুভমেন্ট দলের নেতা জোহাইর মাগজাউই, যাকে সাইদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা হয় এবং আয়াচি জামেলের প্রার্থিতা গ্রহণ করেছে, অন্য ১৪ জনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটিকে বিরোধীরা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাদ দেয়ার পদক্ষেপ বলে ব্যাপক সমালোচনা করেছে।

আরো জানা যাচ্ছে, সেই তালিকা থেকে আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে আরো তিনজনকে বাদ দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কর্তৃপক্ষের এই প্রাথমিক যাচাই-বাছাই থেকে তারা বাদ পড়ায় তারা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। এরপর আদালত তাদের আপিলের অনুমতি দেন। এই তিনজন হলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মোনসেফ মারজাউকির উপদেষ্টা ইমেদ দাইমি, সাবেক মন্ত্রী মনধের জেনাইদি ও বিরোধীদলীয় নেতা আবদুল লতিফ মেক্কি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদের বিরুদ্ধে তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আয়াচি জামেল কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর আবারো গ্রেফতার হন। ব্যালটে স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে আয়াচি জামেলকে গ্রেফতার করা হয়। চার দিন হাজতবাস শেষে রাজধানী তিউনিসের অদূরে মানৌবা শহরের একটি আদালত তাকে অস্থায়ী জামিন দেন। আয়াচি জামেল দেশটির সাবেক সংসদ সদস্য ও একজন ব্যবসায়ী। গত আগস্টের শেষ পর্যন্ত আজিমন নামে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত দেশটির একটি ছোট রাজনৈতিক দলের প্রধান ছিলেন তিনি। তবে আগস্টের শেষে এসে আয়াচি জামেল দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিউনিসিয়ার নির্বাচন কমিশন চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টা পর আয়াচি জামেলকে গ্রেফতার করা হয়। এ আটকাবস্থাকে দেখা হচ্ছে বিরোধী মত দলনের কাজ হিসেবে।


প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার আগে বিগত সপ্তাহে তিউনিসিয়ার বৃহত্তম বিরোধী দলের কয়েক ডজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশটির আরববসন্তের পর ক্ষমতায় আসা ইসলামপন্থী দল আননাহদা বলেছে, দলটির শত শত নেতাকর্মীকে দেশব্যাপী একটি অভিযানের অংশ হিসেবে আটক করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট সাইদের উত্থান বছর কয়েক আগে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্তের মাধ্যমে। এরপর পানি অনেকখানি গড়িয়েছে এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ পানি যথেষ্ট ঘোলা করার পর নিজের অবস্থান অনেকটা সংহত করে নেন। তিনি ২০২২ সালে প্রধান দলগুলোকে বাদ দিয়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন দেন, যে কথা আগেই বলেছি। বিশ্লেষকরা তখন বলেছিলেন, এই পার্লামেন্ট লং রানে কতটা সুফল আনবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। প্রধান রাজনৈতিক দল আননাহদাসহ ১২ দল নির্বাচন বর্জন করায় ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৮.৮ শতাংশ । বিরোধী দলগুলো সফল হয়েছে ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পেরে। প্রেসিডেন্ট সাইদ এই পঙ্গু ফলাফল নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। আর দমননীতির ফলে তার ক্ষমতা টিকে যায়। এবারেও তিনি নির্বাচনের আগেভাগেও আরেক প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। ৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী আহমেদ হাচানিকে বরখাস্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ। তবে কী কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা জানা যায়নি। এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাচানিকে বরখাস্ত করার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিউনিসিয়ার সামাজিক বিষয়কমন্ত্রী কামেল মাদৌরিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর আগে গণপরিবহনে অসুবিধা মোকাবেলায় সরকারি বৈঠক নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন হাচানি। এটিই তার কাল হয়েছে। গত বছরের আগস্টের শুরুতে দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাচানি। তিনি নাজলা বৌদেনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। তাকেও কোনো কারণ ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন সাইদ। একজনের পর একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেও দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে পারেননি তিনি।

গণতান্ত্রিক বিশ্ব তিউনিসিয়ার এই নির্বাচনকে ভালো চোখে দেখছে না। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বলেছে, জামেলের গ্রেফতার ও তিনজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ‘গণতন্ত্রের জায়গাটিকে ক্রমাগত সীমাবদ্ধ’ করে তোলা হচ্ছে, তা প্রতীয়মান হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, নির্বাচনের দৌড়ে অন্তত আটজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে ‘বিচারের মুখোমুখি করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে বা কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে’। মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ আইএসআইই সাইদের পক্ষে কাজ করছে।

বিরোধী দলগুলো বলছে, কারাবন্দী রাজনীতিবিদদের মুক্তি না দিলে এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দেয়া না হলে সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এবারের নির্বাচনেও এখন মূল প্রার্থী প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ। তিনি নির্বাচিত হবেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কিন্তু একতরফা শাসন থেকে বের হতে না পারলে দেশটির সঙ্কট থেকেই যাবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান প্রধান দলগুলোকে বাদ রেখে নির্বাচন করার এই পুরনো কৌশল দেশকে সঙ্কট থেকে উত্তরণে সহায়তা করবে না। বিরোধী দলগুলো কত দিনে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে সেটি সময়ই বলে দেবে।


আরো সংবাদ



premium cement