২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

হাসিনার পতন ফ্যাসিস্টদের জন্য শিক্ষা

- ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীনতা যুদ্ধেরও অনেক পরে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আমার জন্ম। তখন বাংলাদেশ ছিল উন্নয়নের স্বর্ণ শিখরে। শেখ মুজিবুর রহমানের তৈরি করা তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করা রাষ্ট্র তখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাবলম্বী রাষ্ট্রের রূপ নিয়েছে। আইনের শাসন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাচে গণতন্ত্রের সুবাতাস বয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার জন্মের এক বছর পরই ঘাতকের নির্মম গুলিতে প্রাণ হারান জাতির মহানায়ক, উন্নয়নের রূপকার, স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রের শাসনভার চলে যায় এরশাদের স্বৈরশাসনের কবলে। প্রায় এক দশক পর যখন বুঝতে শিখেছি তখন স্বৈরশাসক এরশাদকে বিদায় নিতে হয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কাছে পরাজিত হয়ে। দেশে আবারো ফিরে আসে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের আবহাওয়া। শুরু হয় রাষ্ট্র মেরামতের কাজ। একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রকে উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে, ঐক্যের বিকল্প নেই। বিকল্প নেই সুশসান ও গণতন্ত্র চর্চার। সেই দিকটি বিবেচনায় রেখে জাতি যেন ভোটের সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেই লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন বিশ্বাসযোগ্য সরকার হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সাল পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসার রাজনীতি ও ক্ষমতা এককভাবে ভোগ করার বাকশালী রোগে আক্রান্ত হয়ে, গণতন্ত্রের পথকে এখানেই রুদ্ধ করে দেন।

আওয়ামী লীগের মদদে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাসমর্থিত একটি অরাজনৈতিক শক্তি যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ। তাদের সাথে আপস করে দুই বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালের শুরু থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনা জাতির জন্য বলকানের কসাই হয়ে অগণতান্ত্রিক উপায়ে নিষ্ঠুর ও নির্মম শাসন চালিয়ে গেছেন। দীর্ঘ ১৬টি বছর বিরোধী রাজনীতির ওপর নিষ্ঠুরতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে হিটলার-মুসোলিনির জমানাতেও কেউ তা প্রত্যক্ষ করেনি। মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন ভোটের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা। আইনের শাসনকে বুটের নিচে চাপা রেখে স্বৈরতন্ত্রের সব অস্ত্রই ব্যবহার করেছেন মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য। দুর্নীতির মহাপ্লাবনে ভাসছিল দেশ। আওয়ামী লীগের প্রত্যন্ত এলাকার একজন কর্মীও কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তাদের কথাই ছিল আইন। তারাই করত বিচার। বিচার বিভাগ নামেমাত্র ছিল। সবাই শেখ হাসিনার কাছে বিচার চাইত। বিচারহীনতার আবহাওয়া তৈরি করে, সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে হরিলুটের রাজ্যে পরিণত করেছিল রাষ্ট্রের সব সংস্থাকে।

আওয়ামী লীগ তার ১৬ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে একটি সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে। পুলিশ এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, থানা-হাজতে টর্চার সেল বানিয়ে নির্যাতন করা হতো ভিন্নমতের লোকদের। আয়নাঘর নামের কক্ষে মানুষকে গুম করে আটকে রাখা হতো বছরের পর বছর। গুমের পর কতজনকে যে হত্যা করেছে তার হিসাব মেলানো বড় দায়! এমন একটি ভীতিকর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের জনগণকে বের করে আনার জন্য দীর্ঘ ১৭টি বছর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে থেকেই সংগ্রাম করে গেছে। অবশেষে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ছাত্র-জনতার মহান বিপ্লবের কাছে পরাজিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা।

এখানে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করা দরকার। ছাত্র-জনতার প্রায় এক মাসের আন্দোলনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর ভ‚মিকা ছিল অনেক বেশি। দীর্ঘ ১৭ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামে বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। জেল-জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতনের হাত থেকে এক মুহূর্তও রক্ষা পায়নি কেউ। গণতন্ত্রের জন্য ছিল এই লড়াই। এই লড়াই ছিল ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার। আজকে যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদেরও বেশির ভাগ সব সময় গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকারের কথাই বলে এসেছেন। কাজেই তাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা।

ফ্যাসিস্ট মনোভাব নিয়ে জনগণকে দমিয়ে রাখার সব কৌশল প্রয়োগ এবং জীবননাশক অস্ত্র প্রয়োগ করেও জনরোষ থেকে শেখ হাসিনা নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেও কোনো রাষ্ট্রই তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হচ্ছে না। কারণ তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পশ্চিমা বিশ^কে শত্রæ বানিয়ে কেবল ভারতকে তার বিশ^স্ত বন্ধু বানিয়েছিলেন। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বস্ত ভারতের কাছে। বলেছিলেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি, তা চিরদিন মনে রাখতে হবে।’ এখন তার পুরস্কার হিসাবে সেই ভারতেই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছে।

শেখ হাসিনার পতনের আগের দিনও আওয়ামী লীগ গর্জন দিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাঠেই ছিল। কিন্তু হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব এখন প্রশ্নের মুখে। এই দল আদৌ কোনো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা হয়তো সময়েই বলা যাবে, তবে মাত্র এক দিনের ব্যবধানে দলটির কোনো নেতাকর্মীকেও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এত শক্তি, দাম্ভিকতা, বাগাড়ম্বর মুহূর্তেই সব হারিয়ে গেল? এখানে একটি শিক্ষা হতে পারে, জনগণকে ক্ষেপিয়ে রাজক্ষমতা যেমন ধরে রাখা যায় না, রাজনৈতিক দল হিসেবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায় না। গণতন্ত্র সামনে রেখে যে দেশের জন্ম হয়েছে সেই দেশে গণতন্ত্রহীনতা যে টিকে থাকতে পারে না, হাসিনার পতন তারই দৃষ্টান্ত।

একটি কথা জোর দিয়েই বলা যায়, হাসিনার পতনের অন্যতম কারণ তার দাম্ভিকতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জাতিকে বিভক্ত করা। আওয়ামী লীগার ছাড়া ছাড়া সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বানিয়ে গোটা জাতির মধ্যে তিনি বিভেদ ও হিংসার দেয়াল তুলেছিলেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়লে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা ভারতের মাটিতে পালিয়ে গিয়ে আরাম আয়েশে দিন যাপন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শিবিরের আশপাশেও তাদের দেখা যায়নি। মেজর জলিল তার অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত ভারতীয় বিএসএফের অফিস খালি করে তাজউদ্দীন গঠিত মন্ত্রিসভাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়। এর আগেই মন্ত্রিসভার সদস্যদেরকে আমি দেখেছি আনুমানিক ৫৬/এ, বালিগঞ্জে অবস্থিত একটি দোতলা বাড়ির দোতলায় মেসে ভাড়া থাকা বেকার যুবকদের মতো গড়াগড়ি করতে এবং তাস খেলতে।’ তিনি আরো লিখেছেন, দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ জনগণকে হিংস্র দানবের মুখে ঠেলে দিয়ে কলকাতার বালিগঞ্জের আবাসিক এলাকার দ্বিতল বাড়িতে বসে প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভাসহকারে (খন্দকার মোশতাক আহমদ বাদে) নিরাপদে তাস খেলছিলেন দেখে আমি সে মুহূর্তে কেবল বিস্মিতই হইনি, মনে মনে বলছিলাম, ‘ধরণী দ্বিধা হও’। শুধু তাই নয়। তার লেখায় আরো এসেছে, আওয়ামী লীগের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে কলকাতার অভিজাত এলাকার হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোতে জমজমাট আড্ডায় ব্যস্ত থাকতেন। কফি, বিয়ার-হুইস্কি পানে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ নেতারা সেদিন এই দেশের রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের কথা একবারও মনে করেননি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পর বীরের বেশে দেশে ফিরে এসে বড় মুক্তিযোদ্ধা সেজে বসেছেন। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ না করে ১৬ ডিসেম্বর যে লুটতরাজ বাহিনীর জন্ম হয়েছিল, যাদের নাম হয়েছিল ‘সিক্সটিন্থ ডিভিশন’, সেই বাহিনীর সদস্যরাই পরে হয়ে গেছে বড় মুক্তিযোদ্ধা। এসব কথিত মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে হারিয়ে গেছে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়। এই প্রজন্মের মানুষ যখন ইতিহাসের এই প্রকৃত সত্য জানতে পারছে, তখন তারা আওয়ামী লীগ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আর বিপক্ষের শক্তি’ এই তকমা দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। জনগণের এই ভালো না লাগার পরিণতি ভুগছে আজকের আওয়ামী লীগ। জনগণ তাদেরকে যে শিক্ষা দিলো তা ইতিহাসের পাতায় একটি আলাদা অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। সব রাজনৈতিক দলেরই উচিত এই শিক্ষা অনুসরণ করে জনগণের কল্যাণে কাজ করা। নতুবা, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মতোই পচে গলে নষ্ট হয়ে যাবে।

harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement