২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মধ্যবিত্তের স্বরূপ

-

আমরা যারা মধ্যবিত্তের তকমা মাথায় চাপিয়ে জীবন যাপন করছি এবং একই সাথে অজস্র সমাজপুষ্ট আলগা নীতিবোধের ফিরিস্তি সাজিয়ে বসে আছি, সেখানে চক্ষুলজ্জা স্বয়ং নিজেই যেন মস্তবড় দানবের মুখ গহ্বর। বিশাল এক হাঁ করে বসে আছে, পান থেকে চুন খসলেই গিলে ফেলবে। আর নীতিবোধ, সে তো বেলজিয়ামের বিখ্যাত স্বচ্ছ পাতলা কাচের গ্লাস। দিনের পর দিন অতি যত্নে আলিঙ্গন করে রাখি কিন্তু একদিন সহসাই হালকা গুঁতোয় ভেঙে খান খান।

এখানে ব্যক্তি মানুষ কেবলই খেলনা মাত্র যার নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই; বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ‘মধ্যবিত্তের’ অভিশপ্ত দায়ভার নিজ কাঁধে নিয়ে একটি অদৃশ্য চক্রাকার কক্ষপথে হেঁটেই চলছে। আর যে সমাজে আমাদের বসবাস, তাকে তো মাঝে মধ্যে মনে হয় রোমের কোলোসিয়াম। কানায় কানায় পরিপূর্ণ গ্যালারি, সবাই একটি অসম লড়াইকে বাহবা দিচ্ছে আর সজোরে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে ‘চালিয়ে যাও’। তারপর সেই অসম লড়াইয়ের সমাপ্তি শেষে পরাজিতকে সান্ত্বনাসূচক ‘উফ’ শব্দটি বলেই সবাই পরবর্তী লড়াই দেখার জন্য যেন উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে যখন সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালি’ হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরলেন, তখন সারা বিশ্বে এক হইচই পড়ে গিয়েছিল। ‘পথের পাঁচালি’ নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই, কিন্তু আমি আমার মতো করে বলতে পারি, ‘পথের পাঁচালি’ আসলে বাংলা ও বাঙালির দর্পণ, দিন শেষে একটি প্রথা ভাঙার গল্প, নতুন স্বপ্নের বীজ বপনের গল্প। প্রথা তো মানুষেরই তৈরি, আমরাই তাকে পরম মমতায় চাদর বানিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখি। আমরা যেন প্রথার মধ্যেই সর্বদা আবদ্ধ, তা সে যেকোনো গোষ্ঠী, শ্রেণী কিংবা জাতিভেদেই হোক না কেন।

আমার জন্ম এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে, তাই মধ্যবিত্তের স্বরূপ চিনতে আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে মধ্যবিত্তের একটি আলাদা মূল্যবোধের জায়গা আছে। মধ্যবিত্তদের সমাজে বাঁচতে হলে শিক্ষিত হতে হয়, সহনশীল হতে হয়, মধ্যবিত্তরা চাইলেই এমনটি করে না, মধ্যবিত্তরা চাইলেই এমনটি পড়ে না, মধ্যবিত্তরা এমনটি খায় না। মধ্যবিত্তের আর কিছু নাই থাকুক প্রবল আত্মসম্মান আছে, মধ্যবিত্তের বিবেক আছে, সে শত ঝড়-ঝাপটায় খড়খুটো ধরে বেঁচে থাকার অভিনয় করতে পারে। এভাবেই শত সহস্র নিয়মের চর্চায় একসময় সেগুলো যেন প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সেই প্রথাই একদিন মোটা পুরু চাদরে আমাদের চেপে ধরতে চায়। সেখানে সূর্যের আলো আসার আগে ইতঃস্তত করে, সেখানে জানালার কব্জাগুলো জং ধরে ধরে শক্ত হয়ে আটকে যায়, প্রথা ভাঙার নিয়মটি সেখানে অবৈধ।

এটি যেমন চিরন্তন সত্য যে, পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠীর নিজ নিজ প্রথা থাকে তেমনি আমি এটিও মানি প্রথার মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে থাকে এক ধরনের জীবনদর্শন। কিন্তু যে প্রথা ঘুণপোকার মতো সমাজকে ক্ষয়ে দিয়েছে, মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করেছে সেখানে আর যাই থাকুক দর্শনের কোনো জায়গা নেই। পৃথিবীর ইতিহাসের সেই প্রথম থেকেই মানুষ কেবল বিভাজনে বিশ্বাসী। শক্তির উপর ভিত্তি করে বিভাজন, বর্ণের উপর ভিত্তি করে বিভাজন এবং পরিশেষে সম্পদের উপর ভিত্তি করে বিভাজন, এমনি হয়তো আরো কত নাম না জানা অগণিত বিভাজন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বিভাজন সৃষ্টি করে বিভেদ এবং বিভেদ থেকে কর্তৃত্ব। পৃথিবীর ইতিহাসের যেখান থেকেই শুরু করা হোক না কেন আমার কাছে সবই এক, আমি কেবল বিভাজনের নামে কর্তৃত্ব দেখি। এখানেই আমার বিরোধিতা এখানেই পথের পাঁচালির কারিশমা। আমি কোনোমতেই সম্পদের বিন্যাস যা আমার হাতে নেই তার উপর ভিত্তি করে কোনো সমাজপুষ্ট শ্রেণিবিন্যাসে আবদ্ধ হতে চাই না।

‘আগামী শতাব্দী হবে..’-এই শীর্ষক এক বারোয়ারি বিতর্কে একেক জন তার্কিক তাদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছিল। মঞ্চের বাঁ দিকের সারিতে বসে থাকা একজন তার্কিক উঠে দাঁড়াল তারপর হালকা একটু কেশে বলা শুরু করল ‘আগামী শতাব্দী হবে মধ্যবিত্তের’। ২২ বছর আগের সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতার সব কথা ভুলে গেছি, শুধু মনে আছে ওই একটি লাইন। তখনো একাবিংশ শতাব্দী শুরু হয়নি। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এত দিন পরে এসে বলতে পারি সেই মধ্যবিত্তের যে রূপরেখায় বলেছিল তার সাথে বর্তমান মধ্যবিত্তের কোনো মিল নেই। কিন্তু সেদিন হয়তো সেই তার্কিকটি একের পর এক যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, পৃথিবীর অস্তিত্বের স্বার্থে মধ্যবিত্তরা কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এবং আধিপত্য বিস্তার করবে।

আমি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। চতুর্দশী বয়সের সহজ মনের একটি ছেলে যার বেড়ে উঠা একটি মধ্যবিত্ত পরিবেশে সে সমাজের অনেক রূপ না দেখলেও উদ্ভট, শত বছরের দাসত্ব আর হীনম্মন্যতা দেখে বড় হয়েছে, তার কাছে এই কথাগুলো স্বপ্নের মতো হতেই পারে। কিন্তু আমি তার অনেক আগেই বুঝে নিয়েছিলাম, বিত্তের উপর ভিত্তি করে সমাজের যে শ্রেণিবিভাগ কিংবা শ্রেণিবিন্যাস তাকে আমি চরমভাবে ঘৃণা করি। সেদিনের সেই তার্কিক ছেলেটি হয়তো আমার থেকে বয়সে অল্প কিছু বড় হবে কিন্তু সেদিন সে মধ্যবিত্তের জয়জয়কারের মধ্য দিয়ে এই তথাকথিত সমাজের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকেই হয়তো ভাঙতে চেয়েছিল। এ কথা সত্যি, সে দিন যেমন সে নিজে স্বপ্ন দেখেছিল তেমনি স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আর সেই স্বপ্নে আর কেউ বিমোহিত না হলেও আমি অন্তত হয়েছিলাম।

স্বপ্ন হচ্ছে অনেকটা কাচের বাক্সের ভেতরে রাখা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। যতক্ষণ ওই বাক্সের ভেতরে আছে ততক্ষণ খুব সুন্দর আর যেই মুহূর্তে বাতাসে এলো ওমনি চুপসে যায়। আর মধ্যবিত্তের স্বপ্ন আরো অদ্ভুত, কাচের বাক্স ভেঙে যাবে শুধু এই ভেবে হাওয়াই মিঠাই কোনো দিন বাতাসে আসতে পারল না, আর চুপসে যাওয়া সে তো অনেক পরের কথা। মধ্যবিত্তরা শুধু স্বপ্ন লালন করতে ভালোবাসে তাকে যেকোনো মূল্যে বেঁধে রাখতে চায় কিন্তু তার পিছু ছুটতে যত ভয়।


আরো সংবাদ



premium cement