১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`

যুদ্ধবিরতিতে গাজায় আনন্দ ও বেদনা

গাজার দেইর এল-বালাহতে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তির খবরে উল্লাস করছে ফিলিস্তিনিরা : ইন্টারনেট -

গাজা উপত্যকায় বহু ফিলিস্তিনি এখন উদযাপন করছেন। মনে আশা, ১৫ মাসের বিধ্বংসী যুদ্ধ অবশেষে শেষ হয়েছে। কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে ইসরাইল ও হামাস। বন্দী ও যুদ্ধবন্দী বিনিময় এবং গাজার বিভিন্ন এলাকায় ফিলিস্তিনিদের ঘরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকবে এ চুক্তিতে।
যুদ্ধবিরতির খবরে গাজায় ফিলিস্তিনিরা উল্লাসে মেতেছেন, কিন্তু সেই উদযাপনের সাথে মিশে আছে শোক। এ যুদ্ধে তারা অসংখ্য প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। এ যুদ্ধকে মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসঙ্ঘ বিশেষজ্ঞরা ‘গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি আলজাজিরাকে বলেন, সুযোগ পাওয়ার পর মুহূর্তেই তারা নিজের শহর ও গ্রামে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। ইসরাইলি হামলা এবং তথাকথিত ‘উচ্ছেদের নির্দেশনার’ কারণে তারা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইসরাইলি বোমায় ১০ সন্তানের মধ্যে দু’জনকে হারান ৬৬ বছর বয়সী উম্মে মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে উত্তর গাজার বেইত হানুনে ফিরে আমার জন্মভূমির মাটিতে চুমু খাব। এ যুদ্ধে আমি বুঝেছি ঘর-দেশ এবং সন্তানই আমাদের আসল সম্পদ।’ গাজায় ইসরাইলের আক্রমণে ৪৬ হাজার ৫০০-’র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখেরও বেশি।
গাজায় হামলা চালিয়ে ইসরাইল ধারাবাহিকভাবে স্কুল, হাসপাতাল ও বাস্তুচ্যুতদের শরণার্থী শিবির ধ্বংস করেছে। এসব হামলায় জীবনধারণের প্রয়োজনীয় প্রায় সব কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ স্যাটেলাইট সেন্টার দেখতে পায়, গাজার ৬৬ শতাংশ অবকাঠামো ইসরাইলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। যুদ্ধের শুরুতেই গাজার ওপর বিদ্যমান অবরোধ আরো কঠোর করে ইসরাইল। এতে ব্যাপক খাদ্যসঙ্কট ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এখন যুদ্ধের দুর্ভোগ আপাতত শেষ মনে হলেও, ফিলিস্তিনিরা তাদের প্রিয়জন এবং সর্বস্ব হারানোর বিষয়টিতে ধাতস্থ হতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দেইর আল-বালাহর ৪৭ বছর বয়সী মেডিক মোহাম্মদ আবু রাই বলেন, আমার অনুভূতি মিশ্রিত তবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি, নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে না ভুগি।
স্মৃতি ও শোক
যুদ্ধবিরতির আগে ইসরাইলি হামলায় প্রাণ হারানো প্রিয়জনদের নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করছেন ফিলিস্তিনিরা। গাজা সিটির ইন্টারন্যাশনাল আমেরিকান এলিমেন্টারি স্কুলের প্রিন্সিপাল লুবনা রাইয়েস বলেন, তিনি তার সহকর্মী বিলাল আবু সামানকে হারিয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধার করার সময় তিনি বোমায় নিহত হন। রাইয়েস বলেন, তিনি প্রায়ই বিলাল আবু সামানের বিধবা স্ত্রীকে ফোন করেন; তার ছোট ছোট সন্তানদের খোঁজখবর নেন। মিসরের কায়রো থেকে ফোনে আলজাজিরাকে রাইয়েস বলেন, তিনি ছিলেন অসাধারণ ও খুব দয়ালু শিক্ষক। তার মৃত্যুতে আমি গভীর আঘাত পেয়েছি। বিলাল সত্যিই পৃথিবীর সেরা মানুষদের একজন ছিলেন।
রাইয়েস গত বছর থেকে স্বামী ও তিন সন্তানকে কায়রোতে বাস করছেন। ইসরাইলি সেনাদের দেয়া আগুনে তার পারিবারিক বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই বাড়িতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোনো পারিবারিক ছবি, কোনো স্মৃতিই আর নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। আবু রাইও বাড়ি হারিয়েছেন। তবে রাইয়েসের মতোই তিনিও বলেন, নিহত সহকর্মী ও বন্ধুদের স্মৃতিই তাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা কষ্ট দেয়। তিনি মনে করেন, ইসরাইলের হামলায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আনুষ্ঠানিক হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। গত ১৫ মাসের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও কিভাবে বেঁচে আছেন, তা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেন না রাই। গাজায় সবসয়ই স্রেফ ভাগ্যের জোরে বেঁচে থেকেছি বলেন তিনি।
গাজায় থাকবেন নাকি অন্য কোথাও পাড়ি দেবেন
ফিলিস্তিনের অধিকাংশ মানুষ তাদের সম্প্রদায় ও ঘরবাড়ি পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখলেও অনেকেই অবরুদ্ধ গাজায় থাকার কথা আর কল্পনাও করতে পারছেন না। ৫২ বছর বয়সী মাহমুদ সা’দা মনে করেন, যুদ্ধবিরতির প্রত্যাশা থাকলেও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হবে না। তিনি বলেন, মিসরের সীমান্ত খুললেই তিনি তার ছোট সন্তানদের নিয়ে গাজা ছেড়ে চলে যাবেন। দেইর আল-বালাহ থেকে তিনি আলজাজিরাকে বলেন, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, গাজায় আর ফিরব না। আমি খুব ক্লান্ত, খুব বিরক্ত। গাজা ছেড়ে যেকোনো জায়গায় চলে যেতে চাই, যোগ করেন তিনি।
আবু রাইও মনে করেন, সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায় থাকা এখন অসম্ভব। তার মতে, অধিকাংশ বেঁচে যাওয়া মানুষ গভীর মানসিক আঘাতে ভুগছেন এবং তাদের সম্প্রদায় ও জীবন আবার গড়ে তোলার ভাবনাও অনেকের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। তিনি বলেন, এখন মনে হচ্ছে, অনেকেই অন্তত কিছু সময়ের জন্য গাজা ছেড়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন। আবু রাই বলেন, এত ধ্বংস হয়েছে, আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। প্রতিবার আমাদের সম্প্রদায় পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে জীবনের অনেক সময় হারিয়ে যায়। যে দিনগুলো হারিয়ে যায়, সেগুলো আর ফিরে আসে না।
তবে আবু রাই, রাইয়েস এবং উম মোহাম্মদ সবাই একমত যে, গাজা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনেকের জন্যই কঠিন। কারণ ফিলিস্তিনিরা তাদের মাতৃভূমিকে মিস করবেন। তারা বিশ্বাস করেন, শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ গাজায় ফিরে যাবেন বা সেখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেবেন। রাইয়েস বলেন, আমাদের শেষমেশ ফিরে যেতে হবে, জানেন তো? বাস্তবেই, বাড়ির মতো আর কোনো জায়গা নেই।


আরো সংবাদ



premium cement