ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে ইরান কতটা উদ্বিগ্ন
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
-যুক্তরাষ্ট্র আগেই বলেছে, ইরানের তেল ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা চায় না
-ইরানে হামলা চালানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি ইসরাইল
লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান ও বেশ কয়েকজন শীর্ষ ইরানি কমান্ডার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইসরাইলে প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে ইহুদিবাদী দেশটি। চিরবৈরী দখলদার রাষ্ট্রটির পাল্টা হামলার মাত্রা যাতে কম কিংবা কার্যত ব্যর্থ হয়, সে জন্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইরান। খবর : সিএনএন ও আলজাজিরার।
তবে কি ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলার শঙ্কায় ইরান উদ্বিগ্ন? এক সূত্রের বরাতে সিএনএন জানিয়েছে, ইরানের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও রয়েছে। ইরানের তেল ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা ঠেকাতে ইসরাইলকে বোঝাতে যুক্তরাষ্ট্র সফল হবে কি না, তা নিয়ে দেশটি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া সম্প্রতি ইসরাইলের ক্রমাগত আক্রমণে এই অঞ্চলে ইরানের সহযোগী হিসেবে পরিচিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়াতেও চিন্তায় ইরান।
অন্য দিকে ইরানের গত ১ অক্টোবরের হামলার জবাব ইসরাইল কিভাবে দেয়, তা জানতে দীর্ঘ দিনের মিত্র দেশটির সাথে এখনো আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যে ইরানের তেল ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চায় না, সেটি দেশটির কর্মকর্তারা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।
এ দিকে ইরানে পাল্টা আঘাত হানার বিষয়ে ইসরাইলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে গত শুক্রবার সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন দেশটির একজন কর্মকর্তা। এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মধ্যে দূরত্ব কমে আসতে থাকায় সেটি (হামলা তীব্রতা) সেভাবে না-ও হতে পারে। ইসরাইলি মন্ত্রিসভার বৈঠকের বিষয়ে প্রশাসনের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘তারা মত (হামলার পক্ষে) দিয়েছে কি না, আমরা জানি না।’
দুই মাসের মধ্যে গত বুধবারই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিহুর সাথে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, ইসরাইলের পাল্টা হামলা ‘সমানুপাতিক’ হবে, এটাই তার চাওয়া। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং কাতারও ইরানের তেল স্থাপনায় ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শঙ্কার কথা জানিয়েছে। আরব কীটনীতিকরা বলছেন, পাল্টা হামলা হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ বছরের শুরুতে দামেস্কে ইরানের কনসুলেট ভবনে ইরাইলের হামলার পর থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছে দেশ দু’টির মধ্যে। তখন থেকেই দেশ দু’টির মধ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকি চলছিল। বৈরী দেশ দুটি সঙ্ঘাতে জড়ালে তা আঞ্চলিক যুদ্ধ হিসেবে ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা অবধারিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেও টেনে আনতে পারে। আর এটি নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন মার্কিন প্রশাসন। শঙ্কার একটি বড় বিষয় হলো, গত এক বছর ধরেই ইসরাইলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমতে দেখা গেছে।
গাজার মতো লেবাননেও হামলার ক্ষেত্রে সংযম দেখাতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু ইসরাইল ক্রমাগতভাবেই সেসব আহ্বান উপক্ষো করছে। গত এক মাসে লেবাননে ইসরাইলের হামলায় ১৪ শ’র বেশি মানুষের প্রাণহানিও সেটির প্রমাণ দেয়। গত মাসে হিজবুল্লাহর যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করতে তাদের ব্যবহার করা হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটানোর আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু জানায়নি ইসরাইল। সবশেষ বৈরুতে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার আগেও কোনো আভাস দেয়নি। অথচ তার ৪৮ ঘণ্টারও কম সময় আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তথ্যবিনিময়ে স্বচ্ছতার বিষয়টি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ইসরাইলের এক কর্মকর্তা বলেছেন, কৌশলগত খুব বেশি তথ্য তাদের কাছে থাকে না। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো হামলার লক্ষ্য হবে না, এমন কোনো নিশ্চিয়তা গত সপ্তাহ পর্যন্ত মেলেনি ইসরাইলের কাছ থেকে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়ওয়াভ গ্যালান্ট গত শুক্রবার এক কঠোর বার্তায় বলেছেন, ইরানে তাদের হামলা হবে শক্তিশালী। যদিও ইরান হুমকি দিয়ে রেখেছে, ইসরাইলকে সহায়তাকারী যেকোনো দেশকে তারা আগ্রাসনকারী হিসেবে ধরে নেবে এবং এমন প্রতিবেশীরা ইরানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার আওতায় আসবে।
কিন্তু সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং কাতার এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানকে জানিয়ে দিয়েছে, হামলা হলে ইসরাইলকে তারা তাদের আকাশসীমা ব্যবহার করতে দেবে না। জর্দানও তার আকাশসীমায় যেকোনো অনুপবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না, ইরান ইসরাইলের সাথে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়াবে। সম্প্রতি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘নেতানিয়াহুই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি যুদ্ধ চান এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য এ অঞ্চলে আগুন লাগাতে চান।’
অন্য দিকে সম্ভাব্য সঙ্ঘাত এড়াতে প্রতিনিয়িতই ইরানের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে কাতার এবং সেসব তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকেও জানানো হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আমরা আসলে জানি না, ইরান কী করবে।’ দেশটির আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরাইল যদি হামলা করে, তার জবাব কিভাবে দেয়া হবে, তা নিয়ে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বের ভিন্ন পরিকল্পনা থাকতে পারে; কিন্তু সেটিও নির্ভর করবে ইসরাইলের হামলা কতটা শক্তিশালী হয় এবং কতটা সুযোগ পাওয়া যাবে, তার ওপর।
আরব কূটনীতিক বলেছেন, ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে ইরান মূলত সৌদি আরবের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সৌদি আরবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব, সেটিকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সঙ্কট সমাধানে। দুই দেশের কর্মকর্তারা এক মাসের কম সময়ের মধ্যে অন্তত তিনবার বৈঠক করেছেন। গত বুধবারও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাকচি সৌদি আরব সফর করেছেন ‘আঞ্চলিক উন্নয়ন’ এবং ‘লেবানন ও গাজায় ইহুদি আগ্রাসন বন্ধের’ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।
সবমিলিয়ে ইসরাইল কিভাবে ইরানের হামলার জবাব দেয়, সে দিকেই এখন পুরো বিশ্বের নজর। তবে অন্তত ‘ইয়োম কিপ্পুর’ উদযাপনে শনিবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।