ফেসবুক যেভাবে পাশবিক তাণ্ডবের হাতিয়ারে পরিণত হয়
- রোহিঙ্গা নিধন
- ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:০১
মিয়ানমারে নৃগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা চলছিল কয়েক দশক ধরেই। কিন্তু হঠাৎ করেই সেখানে রচিত হয় বিশ্বের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন, নির্যাতনের কালো এক অধ্যায়। এর পেছনে সম্প্রতি ফেসবুকের ভূমিকাকে দায়ী করেছে জাতিসঙ্ঘ।
জাতিসঙ্ঘের তদন্ত কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, মিয়ানমারে বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ফেসবুক। বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি সেখানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ডিটারমিনিং রোল বা পরিস্থিতি নির্ধারণ করার মতো ভূমিকা পালন করে।
গত মার্চ মাসে মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াঙহি লি বলেছিলেন, আমার আশঙ্কা, ফেসবুক এখন তাদের মূল ল্য থেকে সরে গিয়ে একটা পশুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফেসবুক এখন তাদের সেসব ত্রুটি বা ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়েছে এবং দায়ী ব্যক্তিদের ফেসবুক পেজ সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ফেসবুকের যে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, স্বপ্ন তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশে এসে কিভাবে ভুল পথে চলে গেল?
ফেসবুকের ব্যবহার
মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি উন্নয়নে কাজ করে এমন একটি সংস্থা সাইনার্জির প্রধান নির্বাহী থেট স্বেই উইন বলেন, এখনকার সময়ে প্রত্যেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে। পাঁচ বছর আগে অবস্থাটি এমন ছিল না। কিন্তু সর্বশেষ নির্বাচনের পর দেশটির সরকার বিভিন্ন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ করে টেলিকম ব্যবসায় অনেক স্বাধীনতা দেয়। এর প্রভাবটি বেশ লক্ষণীয়। ২০১৩ সালের আগে যে সিমকার্ডের দাম ছিল ২০০ ডলার, তার দাম কমে দাঁড়ায় দুই ডলারে। হঠাৎ করেই এটি বেশ সহজলভ্য হয়ে যায়।
এরপর সস্তা ফোনসেট ও সিমকার্ড সংগ্রহ করেই সবাই মেতে ওঠে ফেসবুকে। কারণটিও সহজ। গুগলসহ বড় বড় অনলাইন পোর্টাল মিয়ানমারের ভাষা সাপোর্ট করে না। কিন্তু ফেসবুকে তা ছিল সম্ভব। এ কারণে লোকজন ফোন কিনে সে দোকানেই ফেসবুক অ্যাপ লোড করে নিত। কিন্তু ইন্টারনেট সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতার স্বল্পতার কারণে তারা প্রোপাগাণ্ডা ও ভুল তথ্যের শিকার হতো।
থেট স্বেই উইন বলেন, তাদের ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো শিক্ষা ছিল না। কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে, কিভাবে খবর ফিল্টার করতে হবে, কিভাবে ইন্টারনেট কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কে তাদের কোনো শিক্ষাই ছিল না।
মিয়ানমারের পাঁচ কোটি লোকের মধ্যে এক কোটি ৮০ লাখ লোক নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করে। কিন্তু দেশটির টেলিকম সংস্থা ও ফেসবুক কোনো পক্ষই নৃগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা মোকাবেলার কোনো প্রস্তুতিই তাদের ছিল না।
ফেসবুক হয়ে গেল অস্ত্র
নৃগোষ্ঠীগত উত্তেজনা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার উভয়টি মিলে বিষের মতো হয়ে গেল। যখন থেকে মিয়ানমারে ইন্টারনেটের ব্যবহারটা ব্যাপক হয়ে যায়, তখন থেকে ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী পোস্ট দেয়া হতে থাকে।
থেট স্বেই উইন বলেন, ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিরোধী পোস্টের মাত্রা এত বৃদ্ধি পেল যে, ফেসবুককেই একটি অস্ত্র মনে হতে লাগল। গত আগস্টে রয়টার্সের একটি তদন্তে এক হাজারের বেশি পোস্ট, মন্তব্য, পর্নোগ্রাফিক ইমেজ এমন পাওয়া গেল, যেগুলোতে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য মুসলিমকে আক্রমণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু পোস্ট এত মারাত্মক ছিল যে, সেগুলো পড়তে গিয়ে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। যখন আমরা বিষয়গুলো ফেসবুকের কাছে পাঠাই, তখনো ফেসবুক সেগুলো সরায়নি। অথচ সেগুলো পাঁচ বছর ধরে ফেসবুকে ছিল!
এর ফলে যখন সেখানে গণহত্যার ঘটনা ঘটল, তখনো অনেকের মধ্যেই কোনো প্রশ্ন দেখা দেয়নি। কেননা ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গিও নির্যাতনকারীদের মতোই হয়ে গিয়েছিল।
সমস্যাটি কোন জায়গায়?
রয়টার্স ও বিবিসির তদন্তের পর নির্দিষ্ট করে দেয়া অনেক পোস্ট, ছবি সরিয়ে নিয়েছে ফেসবুক। কিন্তু এখনো সেখানে এ ধরনের অনেক পোস্ট রয়ে গেছে। ফেসবুক কেন এগুলো সরিয়ে দিচ্ছে না।
এগুলোর পেছনে বড় দাগে কয়েকটি কারণ রয়েছ, প্রথমত মিয়ানমারের ভাষা ও শব্দের ব্যাখ্যা ঠিকমতো না জানার কারণে ফেসবুক এগুলো সরাতে পারছে না। যেমন সেখানে একটি বর্ণবাদী গালি হচ্ছেÑ ‘কালার’, যা মুসলমানদের গালি দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর আরেকটি অর্থও রয়েছে মুরগি। অন্যদের দাবির মুখে এ শব্দটিকে ২০১৭ সালে এ শব্দটিকে নিষিদ্ধ করা হলেও দ্বৈত অর্থ থাকায় এটিকে আবারো উন্মুক্ত করে দিয়েছে ফেসবুক। দ্বিতীয়ত ফেসবুকের নির্দেশনাগুলো ঠিকমতো পড়তে না পারায় মিয়ানমারের লোকেরাও আপত্তিজনক বিষয়গুলো সম্পর্কে ফেসবুককে জানাতে পারে না। আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারের ভাষা বোঝার মতো লোক বা পর্যবেক্ষকের অভাব। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তারা এ খাতে মাত্র একজন লোককে পেয়েছিল, বর্তমানে যা ৬০-এ উন্নীত হয়েছে। ফেসবুক আশা করছে এ বছরের শেষ নাগাদ তা ১০০তে পৌঁছবে।
একাধিক সতর্কবার্তা
মিয়ানমারে ফেসবুক রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ফেসবুককে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দেয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে তারা কিছু কিছু পোস্ট সরিয়ে নেয়। কিন্তু এটি ঠেকাতে তাদের প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা
ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার অভিযোগে ফেসবুক গত আগস্টে ১৮টি অ্যাকাউন্ট, ৫২টি ফেসবুক পেজ ও একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট সরিয়ে দেয়। ফেসবুক এর কারণ হিসেবে জানিয়েছে, এসবের বিরুদ্ধে মারাত্মকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু ফেসবুক সেগুলো সরিয়ে দেয়ার আগেই এ পোস্ট-পেজগুলোর ফলোয়ারের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখে গিয়ে পৌঁছে যায়।
গতি খুবই মন্থর
এক বিবৃতিতে ফেসবুক স্বীকার করেছে, মিয়ানমারে ভুল তথ্য প্রদান ও ঘৃণা কার্যক্রম বন্ধে তাদের পদক্ষেপ খুব মন্থর গতিতে এগোচ্ছে। সাথে সাথে তারা এও স্বীকার করে নেয় যে, ফেসবুকে মিয়ানমারের মতো নতুন কোনো দেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ফেসবুক পরিচালনাকারী প্রধান কর্মকর্তা শেরিল সেন্ডবার্গ মার্কিন সিনেট কমিটির মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি বলেন, ঘৃণা ছড়ানো আমাদের নীতির বিরোধী এবং আমরা এটি ঠেকাতে বদ্ধপরিকর। আমরা এ ব্যাপারে আমাদের নীতি সবার কাছে প্রকাশ করব। কারণ নাগরিক অধিকার সম্পর্কে আমরা ভীষণভাবে যতœশীল। তিনি আরো বলেন, এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরাসরি লোকজনের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলছে, ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে, পরস্পরের প্রতি আচার-আচরণে প্রভাব ফেলছে। সেই সাথে এটি সহিংসতা ও সঙ্ঘাত তৈরি করছে।
গত এপ্রিলে কংগ্রেসের মুখোমুখি হওয়া ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে যখন বিশেষভাবে মিয়ানমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, মিয়ানমারে এ রকম ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশে যেন এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি না হয় সেজন্য একটি দল তৈরির কাজও চলছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা