সাপের দৌরাত্ম্যে পাখিহীন দ্বীপ, রাজত্ব গড়েছে মাকড়সা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:৫৯
যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম দ্বীপে ‘অতি ক্ষুধার্ত’ ব্রাউন ট্রি স্নেকের সংখ্যা এতটাই বেশি যে তারা বনের পাখিদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আরো অবাক করে দেয়ার বিষয় হলো, আশপাশের দ্বীপগুলোর তুলনায় পাখিহীন এই দ্বীপে ৪০ গুণ বেশি মাকড়সার বাস।
ফিলিপাইন থেকে প্রায় ২ হাজার ৪৯২ কিলোমিটার দূরে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের পান্না-সবুজ রঙের আভায় মিশে আছে গুয়াম দ্বীপ। বছর পাঁচেক আগে এক পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছিলেন হল্ড্রে রজার্স। কিন্তু অচিরেই এক অনাহূত অতিথির কারণে বিঘ্ন ঘটে পার্টিতে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল তখন। আগুনে পুড়িয়ে রোস্ট করা হচ্ছিল একটি শূকর। শিখা নিভু নিভু হয়ে এলেও তখনো বেশ উষ্ণ। গল্পে মশগুল হয়ে প্রায় সবাই এদিক-সেদিক চলে যান।
একসময় তারা ফিরে এসে দেখেন, ঝলসানো মাংসের চারপাশে জড়িয়ে রয়েছে বাদামী রঙের একটা অবয়ব। দেহ কুঁকড়ানো, কিছুটা চকচকে ও খসখসে চামড়া তার। উল্লম্ব চোখ আর হাঁ করা মুখ। এই প্রাণীটা ঝলসানো মাংসের টুকরো মুখে দিয়েই গিলে ফেলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া টেক-এর ‘ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হল্ড্রে রজার্স বলেন, ‘ওটা ৪০০ পাউন্ড (১৮১ কেজি) ওজনের শূকর না হলেও একটা বড় পার্টির জন্য তা যথেষ্ট ছিল।’
দীর্ঘ ২২ বছর ধরে গুয়াম দ্বীপের বাস্তুতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
কোনোরকম শিষ্টাচার ছাড়াই যে অতিথি এসে পৌঁছেছিল সেটা ছিল একটা ‘ব্রাউন ট্রি স্নেক’। এই সাপকে ওই দ্বীপে বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারী হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
ব্রাউন ট্রি স্নেক
ব্রাউন ট্রি স্নেক এমন এক প্রজাতির সাপ যারা শিকারে দক্ষ।
এর জন্ম গুয়ামে নয়। অনুমান করা হয়, ১৯৪০-এর দশকে কোনো এক মালবাহী জাহাজে লুকিয়ে গুয়ামে এসে পৌঁছেছিল এই সাপ।
এর আগে চুনাপাথরের ওপর গড়ে ওঠা এই দ্বীপের বনে প্রচুর পাখি ছিল। দ্বীপের অপার্থিব সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলতো এসব পাখির গান।
কিন্তু ওই সাপের আবির্ভাবের মাত্র চার দশকের মধ্যেই পাখির সংখ্যা কমতে থাকে। এই হিংস্র শিকারী সাপের পাল্লায় পড়ে গুয়ামের জঙ্গল এখন বলতে গেলে পাখিশূন্য।
এককালে গুয়ামে বসবাসরত ১২ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০টি প্রজাতিই এখন সেখানে বিলুপ্ত। বাকি দুই প্রজাতির পাখি কোনোমতে হয় দুর্গম গুহায় বা শহরাঞ্চলে টিকে রয়েছে।
যেহেতু পাখি কার্যত এই দ্বীপ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, তাই গুয়ামের আনুমানিক ২০ লাখ সাপকে (তাদের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নেই) নির্ভর করতে হয় ইঁদুর, শ্রু (ছোটো এক প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী), টিকটিকি বা মানুষের খাবারের অবশিষ্টাংশের ওপর।
কলোরাডোর একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘সাদার্ন প্লেনস ল্যান্ড ট্রাস্ট’র নির্বাহী পরিচালক হেনরি পোলক বলেন, ‘ওরা যা কিছু পায়, তাই খায়। পারলে ওরা একে অন্যকে খেয়ে ফেলবে।’ দীর্ঘদিন ধরে গুয়ামের বাস্তুতন্ত্রের ওপর গবেষণা করেছেন তিনি।
হিংস্র সাপের রাজত্বে এই বন থেকে পাখির শিস, কিচিরমিচির একেবারে উধাও হয়ে গেছে। বাইরে থেকে আসা এই সরীসৃপের দৌরাত্ম্যে গুয়াম এই গ্রহের অন্যতম দর্শনীয় অথচ কুখ্যাত স্থানে পরিণত হয়েছে যেখানে পরিবেশগত বিপর্যয়ের চিহ্ন স্পষ্ট।
সাপের উপদ্রবের ফলে এই বন যে পাখিহীন নিশ্চুপ প্রান্তরে পরিণত হয়েছে তাই নয়, এর প্রভাব আরো বিস্তৃত। গুয়াম বিবর্তনের একটা পরীক্ষাক্ষেত্র হিসেবে উন্মোচিত হচ্ছে।
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও সুবিধাভোগীদের তালিকায় রয়েছে আটটি পা ও অসংখ্য চোখওয়ালা এক প্রাণী। ক্ষুধার্ত পাখির খাবারে পরিণত হওয়ার ভয় মিলিয়ে যাওয়ায় দ্বীপটাকে নিজেদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছে তারা।
দুর্ভেদ্য জাল
মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের বেশির ভাগ স্থানেই বর্ষাকালে তুলনামূলকভাবে কম মাকড়সা দেখা যায়। জলবায়ু শুষ্ক হওয়ার ফলে অবশ্য এই প্রাণীটির সংখ্যা বেড়েছে। তবে দ্বীপপুঞ্জেরই অংশ গুয়ামে ছবিটা একেবারে অন্যরকম।
দ্বীপে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু মাকড়সার জালই চোখে পড়ে। এখানে আছে দৈত্যাকার ও হলুদ-পেটওয়ালা ব্যানানা স্পাইডার, সাইকেলের স্পোকের মতো সোনালী রঙের জাল বুনে তারা।
মানুষের হাতের মতো বড় হান্টসম্যান স্পাইডার এবং টেন্ট-ওয়েব স্পাইডারও রয়েছে। গাছের ফাঁক দিয়ে বিশালাকার জাল বুনে এই টেন্ট-ওয়েব স্পাইডাররা।
হল্ড্রে রজার্স জানান, ‘বিশালাকৃতি জালের বিভিন্ন স্তরে নারী মাকড়সা থাকে। আর জালের প্রান্তে থাকে পুরুষ মাকড়সারা।’
এসব জাল ছোট আকৃতির আরজিরোডস মাকড়সাদের কাছে খুব প্রিয়। তারা প্রায়শই এই জালে থাকা বড় মাকড়সাদের শিকারও চুরি করে।
রজার্স বলেন, ‘হাইকিংয়ের সময় একটা লাঠি হাতে তুলে নিয়ে মাকড়সার জাল সরানোটা সেখানে সাধারণ বিষয়। নাহলে আপনি মাকড়সার জালে ঢেকে যাবেন। এই জাল ভেদ করে যাওয়াটা কঠিন।’
এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনার উল্লেখ করেছেন হল্ড্রে রজার্স। তিনি বলেন, ‘এক বন্ধু একবার এমনই একটা জালের একেবারে মাঝখানে গিয়ে পড়ে বৃত্তাকারে ঘুরেছিল। বিশাল জাল তার গায়ে লেপ্টে থাকায় মমির মতো দেখাচ্ছিল। তাকে দেখে অনেকেই ভয় পেয়ে যায়।’
আরেকবার রজার্সের একজন সহকারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তার সাথে ফিল্ডে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বনের মধ্যে মাত্র কয়েক মিটার গিয়েই এই বিশাল জাল দেখে তিনি মত পাল্টান। ‘আমি আর এতে নেই’ বলে ফেলেন তিনি।
দুর্গম জঙ্গল
মাকড়সার দৌরাত্ম্য ছাড়াও গুয়ামের এই বন একটা অদ্ভুত ও প্রতিকূল জায়গা যেমনটা অন্যত্র দেখা যায় না।
মাথার উপরে উঁচু উঁচু ব্রেডফ্রুট গাছ, তার সাথে মিশে রয়েছে অতিকায় সাইক্যাড (এক ধরনের গাছ)। পাশেই ভেন্না গাছ (যার ফল থেকে ক্যাস্টর-অয়েল তৈরি হয়) এবং খোঁচা খোঁচা পাতাযুক্ত কেয়া গাছ। এগুলো ওই জঙ্গলের মাথার ওপর একটা আচ্ছাদনের মতো তৈরি করে যা প্রায়শই টাইফুনের কারণে ছিঁড়ে যায়।
জমিতে তাকালে মাটির দেখা খুব কমই মেলে। তার পরিবর্তে চুনাপাথরের পরত ঠেলে সরাসরি বেরিয়ে আসে গাছপালা।
এই অরণ্য একটা প্রাচীন প্রবাল প্রাচীরের উপরে যা লাখ লাখ বছর ধরে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠে এসে মালভূমি গঠন করেছে। এখনো ওই জঙ্গলে প্রবালের দেখা মেলে। যেখানে পাথর ক্ষয়ে গিয়েছে সেখানে তৈরি হয়েছে ‘সিঙ্ক হোল’ বা গর্ত আর গুহা।
রজার্স বলেন, ‘এখানে হেঁটে বেরানোটা সত্যিই কঠিন কাজ। তীক্ষ্ণ পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার কথা কল্পনা করে দেখুন!’
হল্ড্রে রজার্স ২০১২ সালে যখন গুয়ামের মাকড়সাদের সংখ্যা জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি জানতেন এটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
গুয়ামের বিষয়ে সবসময়ই এই গুজবটা ছিল যে এই দ্বীপে মাকড়সাদের আধিপত্য রয়েছে এবং পাখিদের অনুপস্থিতি এর একটা কারণ হতে পারে। সাধারণত পাখিরা এই মাকড়সাদের খেতে পছন্দ করে।
যাই হোক, রজার্স ব্যাখ্যা করেছেন যে দ্বীপের জনসংখ্যা মোটামুটি ১ লাখ ৮০ হাজার এবং এখানকার বাসিন্দারা উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য জায়গায় খুব কমই ভ্রমণ করেন।
এই দ্বীপপুঞ্জের অন্য দ্বীপগুলো স্বায়ত্তশাসিত কমনওয়েলথ ধরনের সরকার থাকলেও গুয়াম যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। তাই সব মিলিয়ে সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তুলনা করে দেখার সুযোগ কম। বিজ্ঞানীরাও কখনো এই গুজবের বিষয়টা খতিয়ে দেখেননি।
কোটি কোটি মাকড়শা
ঠিক কী পরিমাণ মাকড়সা গুয়াম দখল করে রেখেছে তা জানার জন্য হল্ড্রে রজার্স ও তার সহকর্মীরা বিশেষ এক ধরনের জরিপ শুরু করেন।
এর জন্য তারা সাবধানতার সাথে প্রবাল প্রাচীরের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং সোজাসুজি একটি আঠালো টেপ খুলে রাখছিলেন। টেপের ওই লাইনের এক মিটারের মধ্যে থাকা সব মাকড়সার জাল এবং সেখানে ঝুলে থাকা বাসিন্দাদের সংখ্যা গুনতে থাকেন তারা।
বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে জানানো হয়, আর্দ্র মৌসুমে রোটা, তিনিয়ান ও সাইপানের মতো প্রতিবেশী দ্বীপের চাইতে গুয়ামের বনাঞ্চলে ৪০ গুণ বেশি মাকড়সার দেখা মিলেছে।
শুষ্ক মৌসুমে যখন ওই সব অঞ্চলে মাকড়সার জনসংখ্যা সাধারণত বাড়ে, তখন সেখানকার তুলনায় গুয়ামে দুই দশমিক তিন গুণ বেশি মাকড়সা দেখা গেছে।
শুধু তাই নয়, গুয়ামে ব্যানানা স্পাইডারের জালের আকার ওই অঞ্চলে একই প্রজাতির মাকড়সার জালের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বড় ছিল।
বিজ্ঞানীদের হিসাবে আরো বলা হয়, গুয়ামের সমগ্র বনাঞ্চলে মাকড়সার সংখ্যা ৫০ কোটি ৮ লাখ থেকে ৭৩ কোটি ৩ লাখের মধ্যে।
উল্লেখ্য, এই হিসাব কিন্তু এটা ধরে নিয়ে করা যে একটা জালে একটাই মাকড়সা রয়েছে, যদিও একটা জালে একাধিক মাকড়সার বাস। এছাড়া মাটি থেকে ওপরের দুই মিটার এলাকার মধ্যে থাকা মাকড়সাকেই শুধু হিসাবে ধরা হয়েছে।
মাকড়সার দেহাংশের হিসাবে সব মিলিয়ে এই বন কমপক্ষে ৪০৬ কোটি ৪০ লাখ ‘চোখের’ বাসস্থান।
এদিকে, রোটা, টিনিয়ান ও সাইপান দ্বীপে ব্রাউন ট্রি স্নেক না থাকায় সেখানে এখনো ভালো পরিমাণ পাখির দেখা মেলে। সুতরাং এই সমীক্ষা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে গুয়ামে গত কয়েক দশকে পাখির অনুপস্থিতিতে যে হারে মাকড়সার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনটা একসময় ছিল না।
দক্ষ শিকারি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই গুয়ামে এসে পৌঁছেছিল ব্রাউন ট্রি স্নেক। কিন্তু কমপক্ষে পরবর্তী চার দশকেও তাদের অগোচরে রয়ে যায়।
১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে বাস্তুশাস্ত্রবিদরা লক্ষ্য করেছিলেন যে কিছু একটা দ্বীপের পাখিদের নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। যদিও তারা নিশ্চিতভাবে কেউই জানতেন না এর নেপথ্যে কী কারণ।
সেই সময় পিএইচডি গবেষক ছিলেন জুলি স্যাভিজ। পাখিগুলোর ‘রহস্যময় হত্যাকারীকে’ খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় সন্দেহ করা হয়েছিল যে পাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে কারণ হয় কীটনাশক কিংবা কোনো ভাইরাস।
তার গবেষণা ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হলে জানা যায় যে আসল কারণ হলো সাপ।
দ্বীপে যেসব সরীসৃপ ছিল সেগুলো সব পাখি খেয়ে সাবাড় করে ফেলবে এটা অসম্ভব ছিল।
আসলে কী ঘটছে সেটা যতদিনে ধরতে পেরেছিলেন জুলি স্যাভিজ, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
ফ্লাইক্যাচার প্রজাতির পাখি গুয়ামের জঙ্গলে শেষবার দেখা গিয়েছিল ১৯৮৪ সালে। প্রশস্ত চোখের ছোট্ট পালকের বলের মতো দেখতে ওই পাখি এখন সেখানে বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়। অন্য কয়েকটা প্রজাতি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে।
গুয়াম কিংফিশারকেও বিলুপ্ত বলে মনে করা হয়েছিল। তবে গত বছর তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকে ৫ হাজার ৮৭৯ কিলোমিটার দূরে পলমাইরা দ্বীপে এই প্রজাতির নয়টি পাখি পাওয়া যায়।
আরেক প্রজাতির পাখি গুয়াম রেল, যার স্থানীয় নাম কো’কো। এই পাখিও বিলুপ্ত পাখির তালিকাভুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সংরক্ষণের ফলে এই পাখিগুলোকে রোটা ও কোকোস দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গবেষকরা ব্রাউন ট্রি স্নেকের কারণে তৈরি পরিবেশগত বিশৃঙ্খলার বাস্তব প্রভাব সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
এই সাপগুলেঅকে ধরা খুবই কঠিন। এরা মূলত রাতে গুয়ামের জঙ্গল ও শহরতলির মধ্য দিয়ে চলাফেরা করে, সন্তর্পণে বাতাস থেকে তাদের পরবর্তী নিশানার ঘ্রাণ নেয়।
এই সাপ কোনো সাধারণ শিকারি নয়। ব্রাউন ট্রি স্নেক নিয়মিত এমন প্রাণী খায় যারা তার শরীরের ওজনের প্রায় ৭০ শতাংশ। এটা অনেকটা ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষের একবার বসে একটা লাল ক্যাঙ্গারু খাওয়ার মতো।
সম্প্রতি রজার্সের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের একটা দল সেলি নামক এক প্রজাতির পাখির বেঁচে থাকার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। অ্যান্ডারসন এয়ার ফোর্স বেসের আশেপাশে ওই দ্বীপের উত্তর দিকে এই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন তারা।
গবেষকরা ওই পাখিদের দেহে রেডিও মনিটর জুড়ে দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পাখিদের সাথে কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করা। প্রায়শই ওই সরঞ্জাম শেষপর্যন্ত পাওয়া যেত ব্রাউন ট্রি স্নেকের পাচনতন্ত্রের ভেতরে।
আরো ভয়াবহ আবিষ্কারের মধ্যে ছিল, মৃত পাখি যা ওই সাপেরা খায়নি।
গবেষকরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন অনেক ক্ষেত্রে পাখিদের আক্রমণ করে মেরে ফেলার পর সাপের পালিয়ে গিয়েছে। পাখিদের মৃতদেহ ট্র্যাক করে দেখা গিয়েছিল সেগুলো সাপের লালার আস্তরণে ঢাকা। লক্ষ্য করা যায়, এমন বড় আকৃতির পাখিদের নিশানা করেছিল সাপগুলো যাদের গিলে ফেলা তাদের পক্ষে কঠিন।
তবে ব্রাউন ট্রি স্নেক যে শুধু যে লোভী তেমনটা নয়, তারা দক্ষ শিকারিও। সবচেয়ে দুর্গম জায়গাতেও শিকার খুঁজে পেতে পারে তারা।
অবশিষ্ট স্যালিকে (এক প্রজাতির পাখি) ওই সাপের হাত থেকে বাঁচাতে সংরক্ষণবাদীরা তাদের বাসা বাঁধার বাক্স তৈরি করেছিলেন। ধাতব পাত দিয়ে সেগুলো মজবুত করে গড়ে তোলা হয়েছিল। ৩ ফুট লম্বা এবং প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার জুড়ে পিচ্ছিল ধাতব খুঁটিও লাগানো হয়েছিল, যা বেয়ে সাপের পক্ষে ওঠা কঠিন।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা তখনো এই শিকারির বিশেষ প্রতিভা সম্পর্কে তারা জানতেন না।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির ফিশ, ওয়াইল্ডলাইফ অ্যান্ড কনজারভেশন বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক স্যাভিজের নেতৃত্বে একদল গবেষক ‘ল্যাসো ক্লাইম্বিং’ আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ছিল।
হেনরি পোলক বলেন, ‘ব্রাউন ট্রি স্নেক আক্ষরিক অর্থেই একটা নলাকার পাতের চারপাশে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারে, মাথার চারপাশে লেজ আটকে উপরে চড়তে পারে। ঠিক যেমনটা নারকেল গাছে চড়ার সময় করে থাকে।’ তার মতে এই পদ্ধতি অসাধারণ।
অলঙ্ঘনীয় পরিবর্তন
গত কয়েক দশকে সংরক্ষণবাদী ও বন্যপ্রাণী কর্মকর্তারা গুয়াম থেকে এই সাপকে নির্মূল করতে সব ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। ব্যাপক তল্লাশি, ফাঁদ পাতা থেকে শুরু করে বিষ বা মারাত্মক রাসায়নিকের ব্যবহার- সমস্ত কিছুই সেই তালিকায় ছিল। কিন্তু কোনোটিই কাজে আসেনি।
এমনকি গবেষকরা এমন ভাইরাসের জন্য অনুসন্ধানও করেছেন যাকে এই প্রজাতির সাপের বিরুদ্ধে জৈব অস্ত্র (অন্যান্য প্রজাতির বন্য জন্তুদের প্রভাবিত না করে) হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তবে তীব্র প্রচেষ্টা এবং সাপের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরে ৩৮ লাখ ডলার করে দেয়া সত্ত্বেও ব্যাপক আকারে সাপ নির্মূলের প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
গুয়ামের অ্যান্ডারসন এয়ার ফোর্স বেসে হ্যাবিট্যাট ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের কথাই ধরে নেয়া যাক। বিষাক্ত ট্যাবলেট মিশিয়ে সাপের জন্য খাবারের টোপ দেয়া হয়েছিল। পুরো অঞ্চল একটা বেড়া দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল যাতে সাপ আবার না ঢুকতে পারে। তারপর তাদের সংখ্যা বিমান ঘাঁটিতে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল।
অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে গুয়ামের বন থেকে এই পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ব্রাউন ট্রি স্নেক অপসারণ করা অসম্ভব হবে। তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা তো দূরের কথা।
ধারণা করা হয় যে গুয়ামের প্রায় ৭০ শতাংশ স্থানীয় গাছের বংশ বিস্তার হতো পাখির মাধ্যমে তাদের বীজ অন্যত্র যাওয়ার মাধ্যমে।
কিন্তু নিস্তব্ধ এই বনভূমিতে বর্তমানে অনেক গাছের ফল সরাসরি শুষ্ক মাটিতে ঝরে নষ্ট হয়ে যায়। নতুন গাছ অঙ্কুরিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয়েছে। বছরের পর বছর পাখিরা এসে উপস্থিত না হওয়ায় একাধিক প্রজাতির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা