শিল্পকলা একাডেমির সেই নাটক যে কারণে বন্ধ করা হয়েছিল
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:০২
বাংলাদেশের ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমিতে একটি নাটক চলার সময় ‘উত্তেজিত জনতা আগুন দিয়ে দিবে’ আশঙ্কা প্রকাশ করে একাডেমির মহাপরিচালক নিজেই নাটকটি বন্ধ করে দেয়ার পর এ নিয়ে তুমুল হৈ চৈ চলছে সামাজিক মাধ্যমে।
তবে একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নাটকটি যেই নাট্যদল পরিবেশন করছিল তাদের একজন সদস্যের ফেসবুকে দেয়া একটি পোস্টারের কারণে নাটক বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
তিনি জানান, ‘দর্শক ও অভিনেতাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে’ তাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নাট্য বা সংস্কৃতি চর্চায় এর কোনো প্রভাব পড়বে না। গত সন্ধ্যায় আমি হয়তো একটা লড়াইয়ে হেরেছি কিন্তু এ যুদ্ধে আমরা হারবো না। শিল্পকলা একাডেমি হারবে না।’
যে নাটকটি পরিবেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সেটির পরিবেশক ছিলো নাট্যদল- দেশ। এ দলের কর্ণধার ও নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, একটি নাট্যদলে বহু মানুষ কাজ করে, সেই দলের একজন সদস্যের ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র পুরো নাটক প্রদর্শনী বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়াটা লজ্জার।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘নাটক নিয়ে কারো কোনো আপত্তি ছিল না। যার পোস্ট নিয়ে কথা উঠেছে তিনি তেমন কোনো পরিচিত ব্যক্তিও নন। অথচ যারা এসেছে তারা ডিজিটাল ব্যানার নিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। মহাপরিচালক চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাটকটি শেষ করতে দেয়া হলো না। এটি অগ্রহণযোগ্য।’
উল্লেখ্য, শিল্পকলা একাডেমি মূলত বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যশালা। দেশ নাট্যদল তাদের নিত্যপুরাণ নাটকের ১২৭তম প্রদর্শনী করছিল শনিবার সন্ধ্যায়। এটি করার আগে তারা পাঁচ দিন একাডেমিতেই রিহার্সেল করেছে।
সৈয়দ জামিল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
যে পরিস্থিতিতে নাটক বন্ধ হয়েছিল
নাটক সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সন্ধ্যা সোয়া ৭টা থেকে নিত্যপুরাণ নাটকটির প্রদর্শনী শুরু হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী আগে থেকেই টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছিল একাডেমির টিকেট কাউন্টার থেকে।
তার ঘণ্টাখানেক আগেই ৫০/৬০ জনের একটি দল একটি ব্যানার নিয়ে সেখানে আসেন যাতে দেশ নাট্যদলের একজন সদস্যকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি উল্লেখ করা হয়।
তারা গেইটে এসে হৈ চৈ শুরুর পর খবর পেয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদ সেখানে যান ও তাদের সাথে কথা বলেন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে তিনি নাট্যদলটিকে তাদের নাটক পরিবেশন অব্যাহত রাখতে বলেন।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তিরা আবারো জড়ো হয়ে হৈ চৈ শুরু করলে আবার তিনি সেখানে গিয়ে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।
জামিল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রথম দফায় বলেছি – ওরা চলে গেছে। আমি তাদের বলেছিলাম যে এ নাট্যদলটির অনেকের আন্দোলনেও অবদান আছে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় পারিনি। আমি বাধ্য হয়েছি নাটক বন্ধ করতে। কারণ শিল্পকলায় আক্রমণ হলে ঘটনা খারাপ হতো। বাইরে এর প্রতিক্রিয়া ভালো হতো না।’
তিনি বলেন, ‘নাট্যদলটির একজন সদস্য প্রধান উপদেষ্টা ও কয়েকজন উপদেষ্টাকে জিন্নাহ টুপি পরিয়ে নিম্নরুচির পোস্টার বানিয়ে তা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এটা নিয়েই বিক্ষুব্ধ ছিল উত্তেজিত জনতা। এটার জন্যই এই অবস্থা হয়েছে।’
‘বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা নাটকের প্রদর্শনী বন্ধের দাবি করেছেন। কারণ বিতর্কিত ওই পোস্টার তাদের বিক্ষুব্ধ করেছে। আমার সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। তারা আমার কথা শুনছিল না। সে মুহূর্তে আমি দর্শক ও অভিনেতাদের কথা চিন্তা করেছি।’
সেখানে বিভিন্ন নাট্যদলের যারা ছিলেন তাদের কয়েকজন জানিয়েছেন, মঞ্চে নাটক প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তখনো ওই ব্যক্তিরা নাটক বন্ধ এবং ওই নাট্যদলের একজন সদস্যকে তাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানাতে থাকেন।
এক পর্যায়ে তারা ভেতরে ঢুকে যেতে উদ্যত হলে জামিল আহমেদ একাডেমির মঞ্চে যান। সেখানে তখন নাটক চলছিল।
তিনি কলাকুশলী ও দর্শকদের সামনে নাটক কেন বন্ধ করতে হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দেন ও বলেন যে, নাটক বন্ধ না করলে আরো বিশৃঙ্খল কিছু ঘটতে পারে এবং উত্তেজিত জনতা আগুন দিয়ে দিবে।
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি অনেক চেষ্টা করেছি। বোঝাতে চেয়েছি। কোনোভাবেই...একটা উত্তেজিত মব, এখন ভেতরে ঢুকে পারলে আগুন দিয়ে দেয়। আমি দুঃখিত, আমি লজ্জিত। আর যেই ব্যক্তি এমন পোস্ট দিয়েছে এটা খুব খারাপ হয়েছে। আমি এটাও বলেছি এ দলের কমপক্ষে ২০ জন ছিল আন্দোলনের সাথে। তারা বোঝে, একটু থামে। আবার পেছন থেকে উস্কানি দেয়।’
‘এমন হবে আমি আশা করিনি। আমি ভেবেছিলাম বুঝিয়ে শান্ত করতে পারবো। আমি দুঃখিত, আমি ক্ষমা চাচ্ছি। নাটক বন্ধ না হলে হয়তো এখানে আরো বিশৃঙ্খল কিছু ঘটে যেতে পারতো।’
এ সময় একজন দর্শক জানতে চান তাদের (বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের) অভিযোগ কী? জবাব জামিল আহমেদ বলেন, ‘অভিযোগ হলো আপনাদের দলের একজন পোস্টার বানিয়েছেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন রাজাকার।’
তখন দর্শক সারি থেকে একজন নারী বলেন, ‘সবার তো সব কথা বলবার অধিকার থাকার যুদ্ধ করেছেন আপনারা।’
সৈয়দ জামিল আহমেদ এ পর্যায়ে বলেন, ‘এতক্ষণ যুদ্ধ করলাম। এখন উত্তেজিত জনতা এসে আগুন দিয়ে দিবে। সেটা আরো মারাত্মক হবে।’
রোববার (৩ নভেম্বর) সকালে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনেও পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে জামিল আহমেদ বলেছেন, ‘পোস্টটা ভয়ানক উত্তেজনা তৈরি করেছে কিছু কিছু মানুষের মনে। এটাও মনে হয় যে আওয়ামী লীগের দোসররাও উস্কানিমূলক কথা বলে সমস্যা তৈরির চেষ্টা করছে। সবার উচিত শান্ত হওয়া। শেখ হাসিনার সময়ে যদিও তার বিরুদ্ধে যদি কেউ এভাবে পোস্ট দিতো-তখন কি তার রেহাই হতো?’
দেশ নাটকের কর্ণধার মাসুম রেজা বলেন, তার দলের যে সদস্যের বিরুদ্ধে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিষয়টি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন তারা।
‘দলের একটা সভা করব। তবে আসলে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে- থিয়েটার হার মানছে- এইরকম কোনোকিছু যেন না হয়, আমরা সেই রকম ভাবেই পদক্ষেপ নেব,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
ঘটনার সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন নাট্যদল বাংলাদেশ থিয়েটার দলের কর্ণধার খন্দকার শাহ আলম। তিনি বলেন, যারা বাইরে থেকে এসে হৈ চৈ করেছে তাদের কেউই তাদের পরিচিত বা নাট্য অঙ্গনের লোক নন।
‘তারা নিজেদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দাবি করেছে। আমাদের কথা হলো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে। দল তা নিয়ে ব্যবস্থা নিবে কিন্তু নাটক বন্ধ হবে কেন? কিন্তু তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে করারও কিছু ছিল না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা