০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯ মাঘ ১৪৩১, ২ শাবান ১৪৪৬
`

গৌরীপুরে ডা. মুকতাদির চক্ষু হাসপাতালে ‘স্মৃতি জাদুঘর’ উদ্বোধন

গৌরীপুরে ডা. মুকতাদির চক্ষু হাসপাতালে ‘স্মৃতি জাদুঘর’ উদ্বোধন - ছবি : নয়া দিগন্ত

চক্ষু ‌চি‌কিৎসায় নি‌জের আবিষ্কার ও ব‌্যবহা‌রের যন্ত্রপাতি এবং গ্রাম বাংলার ব্যবহৃত বিলুপ্ত প্রায় জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ডা. মুকতাদির ‘স্মৃতি জাদুঘর’। সেখানে ডা. এ কে এম এ মুকতাদিরের আবিষ্কৃত চক্ষু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১৩টি যন্ত্র উদ্ভাবনের ৪৫ বছর পর সর্বসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হ‌য়ে‌ছে।

শ‌নিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বি‌কে‌লে ময়মন‌সিং‌হের গৌরীপুর উপ‌জেলার বোকাইনগর ইউ‌নিয়‌নের অজপাড়া গা‌য়ে নয়াপাড়া গ্রা‌মে ডা. মুকতাদির চক্ষু হাসপাতা‌ল অডিট‌রিয়া‌মে আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে এ স্মৃ‌তি জাদুঘর‌টি উদ্বোধন করা হ‌য়।

অনুষ্ঠা‌নে ডা. মুক্তা‌দির চক্ষু হাসপাতা‌লের প্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম এ মুকতাদিরের সভাপ‌তি প্রধান অ‌তি‌থি ছি‌লেন তার সহধর্মিনী অধ্যাপিকা ডা. মাহমুদা খাতুন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনী ও স্ত্রী রোগ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান।

বি‌শেষ অতিথি ছি‌লেন উপ‌জেলা নির্বাহী অ‌ফিসার (ইউএনও) এম সাজ্জাদুল হাসান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুনন্দা সরকার প্রমা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডা. ইকবাল আহমেদ নাসের ও গৌরীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মির্জা মাজহারুল আনোয়ার।

স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত দে‌শের খ‌্যা‌তিমান চক্ষু চিকিৎসক অধ্যাপক মুক্তিযোদ্ধা ডা. এ কে এম এ মুকতাদির জানান, তিনি ও তার সহধর্মিণী ডা. মাহমুদা খাতুনের সহযোগিতায় ২০০৪ সালে নিজগ্রাম নয়াপাড়ায় এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এ হাসপাতা‌লে প্রতিবছর জানুয়া‌রি মা‌সে গরিব রোগী‌দের বিনামু‌ল্যে চো‌খে ছা‌নি অপা‌রেশ ও লেন্স সং‌যোজন করা হ‌চ্ছে। ১৯৭৭ সাল থে‌কে তি‌নি গ্রামগ‌ঞ্জে স্কুল ভব‌নে চক্ষু শি‌বিরের মাধ‌্যমে চক্ষু সেবা শুরু ক‌রেন। দীর্ঘ ৪৭ বছ‌রে তি‌নি এক লাখ ২০ হাজার গরিব রোগীর চো‌খের ছা‌নি অপা‌রেশন ও লেন্স সং‌যোজন ক‌রে‌ছেন, যা অব‌্যাহত র‌য়ে‌ছে।

তিনি জানান, ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে নি‌জের উদ্ভাবিত স্মৃ‌তি জাদুঘ‌রে র‌ক্ষিত তার তৈরি যন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে অপথালমোস্কোপ, রেটিনোস্কোপ, ডিসিআর বোন ট্রিফাইন, সেপ্টোপ্লাস্টি কর্নিয়াল ট্রিফাইন, হ্যান্ড হেল্ড সাইনোপটোফোর, পাংটাম ডাইলেটর, ল্যাক্রিমাল গ্রোব, রিভলজি ডিশন চার্ট, ট্রায়াল ফ্রেম, আইপিডি মাপার যন্ত্র। এর মধ্যে ক্রায়ো এক্সট্রাক্টর যন্ত্রটি ১৯৬২ সালে ডা. চারিস ক্যালমেন প্রথম আবিষ্কার করেন। তখন এ যন্ত্রটির দাম ছিল ছয় লাখ টাকা। যা এদেশের চিকিৎসকদের কিনে ব্যবহার করা অসম্ভব ছিল।

ডা. এ কে এম এ মুকতাদির বলেন, ‘আমি সেই যন্ত্রটি দেখলাম, ব্যবহার করলাম। এরপর তিন মাসের পরিশ্রমে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে সেই যন্ত্রটি তৈরি করেছি; যা তরুণ ডাক্তাররা মাত্র এক হাজার টাকায় কিনতে পারবেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেটি ছিল ১৯৭৯ সাল। যন্ত্রটি তখন বিএসটিতে পেটেন্ট করি। এ নিয়ে ওএসবি জার্নালে আমার প্রথম পাবলিকেশন প্রকাশিত হয়। এ প্রযুক্তিটি ১৯৮৩ সালে জার্মানির সিমেন্স কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেই। এতে শুধু দেশ নয়, বিভিন্ন দেশের চক্ষু চিকিৎসকরাও উপকৃত হন।’

জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার এ কে এম এ মুকতাদিরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের নানা স্মৃতি বিজড়িত অসংখ্য নিদর্শনের সমন্বয়ে এ জাদুঘর‌টি সাজানো হয়েছে। স্মৃতি জাদুঘরে দর্শনার্থীদের স্বাগত জানানোর জ‌ন্যে প্রবেশদ্বা‌রে রাখা হ‌য়ে‌ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ‘হুঁকা ও পানদানী’। এছাড়াও রয়েছে নানা সময়ের চশমা, মোমদানী, হারিকেন, কুপিবাতি, কলেরগান (গ্রামোফোন), হেফাকবাতি, করোসিন স্টোব, রেডিও, টেপ রেকর্ডার, হারমোনিয়াম, হাওয়াইয়ান গিটার, তবলা, টেলিফোন, ফ্যাক্স মেশিন, ট্রানজিস্টর ও কেসেটপ্লেয়ার, সাদা-কালো টিভি, টাইপ রাইটার, ভিসিআর ও ক্যাসেট, তারবিহীন ইন্টারকম, সিডি প্লেয়ার, ডিভিডি প্লেয়ার ইত্যাদি।

এছাড়া ৪৭ বছরের প্রকাশিত সংবাদপত্রের কাটিংয়ে দৈনিক নয়া দিগ‌ন্তের একা‌ধিক বিশেষ প্রতিবেদনসহ অসংখ‌্য সংবাদ স্থান পেয়েছে এ স্মৃ‌তি জাদুঘ‌রে। সর্বসাধারণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে স্বাধীনতা পদক, ডা. মুকতাদিররের ব্যবহৃত স্বর্ণের, রূপার ও পিতলের কোটপিন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেয়া অর্ধশত কোর্টপিন। এ স্মৃতি জাদুঘরে নবপ্রজন্মকে বিশ্বের সাথে পরিচিত করতে ৬২টি দেশের মুদ্রা রাখা হয়েছে।

চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২০ সালে দেশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা পদক পান। দেশে গ্রামীণ এলাকায় চোখের চিকিৎসায় অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের বিলাসপুরে ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া অফথালমোজিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে ‘গুরু পুজান’ পদক অর্জন করেন তিনি।

২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর তিনি ভারতের তিরুচিরাপল্লীতে অ্যাসোসিয়েশন অব কমিউনিটি অফথ্যালমলোজি ইন ইন্ডিয়া আয়োজিত অনুষ্ঠানে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, চক্ষু চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাওয়ার্ড, ২০০২ সালে লায়ন্স এফ্রিসিওয়ান অ্যাওয়ার্ড, ২০০৫ সালে এএফএও কর্তৃক ডিসটিংগোয়িং সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড, একেদাস অ্যান্ডওমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ২০১৫ সালে ভারতে গোল্ডমেডেলসহ দেশ ও বিদেশে ১৯টি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন। ডাক্তারি পেশার পাশাপাশি তিনি একজন গিটার বাদক ও বাংলাদেশ বেতারে সর্বোচ্চ গ্রেডের একজন শিল্পী।

আলোচনা শেষে ফিতা ও কেক কেটে জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়।


আরো সংবাদ



premium cement