ঝুঁকিসহন ক্ষমতা ও ব্যাংক খাত
- আশরাফুল ইসলাম
- ০২ মার্চ ২০২০, ০০:০০
একটি দেশের টেকসই অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির স্যালাইন নামে খ্যাত দেশের অর্থসরবরাহ ব্যবস্থা সচল থাকা। আর অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম হলো দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতে সুশাসন বজায় থাকলে অর্থনীতির কর্মচাঞ্চল্য যেমন বাড়ে, তেমনি গতি পায় অর্থনীতি। নতুন নতুন বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করে এ ব্যাংক খাত। তাই ব্যাংক খাত সুস্থ থাকার অর্থ হলো পুরো অর্থনীতিই সুস্থ স্বাভাবিক থাকে।
দেশের ব্যাংক খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, নানা কারণে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিসহন ক্ষমতা কমে গেছে। বিভিন্ন ঝুঁকিতে দেশের ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বড় বড় গ্রাহকের কাছে ব্যাংক ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমে গেছে। গত ১০ বছরে ব্যাংকের মুনাফা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। একই সাথে কমেছে আমানত এবং ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সমতা। কিন্তু এসব সমস্যা যথাযথভাবে আমলে নেয়া বা স্বীকার করা হচ্ছে না। ব্যাংকের মন্দ ঋণ বেড়েছে বিপুল হারে। কিছু গ্রাহককে বিপুল আংকের ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে যে কোনো অবস্থার পরিবর্তন হলে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণ আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর এ কারণেই ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্র বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে বড় ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, বড় ধরনের ধাক্কা এলে ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার ঋণত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে যাবে। এ ধাক্কা মাঝারি মানের হলে মূলধন সংরক্ষণের হার এক শতাংশের নিচে অর্থাৎ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নেমে যাবে। আর এ ধাক্কা ন্যূনতম হলেও মূলধন সংকরক্ষণের হার সোয়া ৮ শতাংশে নেমে যাবে। ব্যাংক খাতের ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই (স্ট্রেস টেস্ট) প্রতিবেদনে এমনই আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
ব্যাংক খাতের যে কোনো অভিঘাত বা ধাক্কা এলে তার সহন ক্ষমতা কতটুকু তা যাচাই করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাইকে ব্যাংকিং ভাষায় স্ট্রেস টেস্ট বলে। কতগুলো সূচক বা নির্দেশকের মাধ্যমে এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। এর মধ্যে প্রধান তিনটি সূচক হলো ঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি, ও তারল্য ঝুঁকি। ঋণ ঝুঁকির মধ্যে আবার পাঁচটি উপাদনান রয়েছ। এর মধ্যে সরাসরি শ্রেণীকৃত ঋণের হার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ শ্রেণীকৃত হওয়া ঝুঁকি, সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসকৃত ঝুঁকি, শ্রেণীকৃত ঋণের মান হ্রাস হওয়াকৃত ঝুঁকি এবং কোনো নির্দিষ্ট খাতে শ্রেণীকৃত হওয়া ঝুঁকি। আর বাজার ঝুঁকির মধ্যে সুদহার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এবং পুঁজিবাজারে মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকি। অপরদিকে তারল্য ঝুঁকি হলো কোনো প্রকার আমানত গ্রহণ ছাড়াই পাঁচ দিন পর্যন্ত গ্রাহকের চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা একটি ব্যাংকের আছে কী নাÑ তা যাচাই করা হয়। প্রত্যেক নির্দেশেেকর তিন রকমের অভিঘাত যাচাই করা হয়। এর মধ্যে ন্যূনতম অভিঘাত, যা শক-১, মাঝারি অভিঘাত যা শক-২ এবং বৃহৎ অভিঘাত যা শক-৩ নামে অভিহিত।
সাধারণত তিন মাস অন্তর এ ঝুঁকিসহন ক্ষমতা যাচাই করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ শেষ স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন দেয়া হয় সেপ্টম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে। সর্বশেষ ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম অভিঘাত বা ধাক্কা সামলানের অবস্থায় নেই। স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সরাসরি শ্রেণীকৃত ঋণ বৃদ্ধির পাওয়ার ক্ষেত্রে। এর পরেই রয়েছে শীর্ষ ঋণগ্রাহকের শ্রেণীকৃত হওয়া। পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট খাত শ্রেণীকৃত হওয়া, সহায়ক জামানতের মূল্যহ্রাস পাওয়া। তবে দেশের ব্যাংকিং খাতে বাজার ঝুঁকির প্রভাব বেশি নয়।
দেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পেক্ষাপট অনুযায়ী, বড় অভিঘাত অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশ বাড়লে ন্যূনতম মূলধন অর্থাৎ ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হবে দেশের ৩৪টি সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। মাঝারি অভিঘাাত অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ বাড়লেও ন্যূনতম মূলধন সংক্ষণে ব্যর্থ হবে ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বড় ঋণগ্রহীতাদের ঋণ বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকির মধ্যে বড় অভিঘাত আসলে অর্থাৎ শীর্ষ ১০ জন ঋণগ্রহীতার ঋণখেলাপি হলে ৩৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা অর্থাৎ শীর্ষ সাতজন ঋণগ্রহীতা ঋণখেলাপি হলে ৩৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। আর ন্যূনতম অভিঘাত অর্থাৎ শীর্ষ ঋণগ্রহীতাও যদি ঋণখেলাপি হন তাহলে ২১টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।
এদিকে এ পর্যন্ত যেসব ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে বেশির ভাগ ঋণেরই পর্যপ্ত সহায়ক জামানত ছিল না। আবার যে পরিমাণ সহায়ক জামানত ছিল তার বেশির ভাগই সরকারি খাস জমি, ভুয়া দলিল, অথবা ঋণের চেয়ে সহায়ক জামানতের মূল্য ১০ শতাংশও নেই। সহায়ক জামানতের মূল্য হ্রাসজনিত ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে সহায়ক জামানতের মূল্য ৪০ শতাংশ কমে গেলে ব্যাংকিং খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশে নেমে আসবে। আর এ ঝুঁকি মাঝারি মানের হলেও অর্থাৎ সহায়ক জমানতের মূল্য ২০ শতাংশ কমে গেলে মূলধন সংরক্ষণের হার সোয়া দশ শতাংশে নেমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্ট্রেস টেস্ট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজার ঝুঁকির ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থায় তেমনে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে, বাজার ঝুঁকি ও ঋণ ঝুঁকি একত্রে আনলে আমাদের ব্যাংক খাত ন্যূনতম ধাক্কাও সামলাতে পারবে না। কারণ, বড় ধরনের অভিঘাত আসলে দেশের ৩৯টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ মূলধন ঋণাত্মক ৭ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে আসবে। আর মাঝারি মানের ধাক্কা আসলেও ৩৮টি ব্যাংক মূলধন হারাবে। অর্থাৎ ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষরেণর হার ১ শতাংশের নীচে (শূণ্য দশমিক ৭ শতাংশ) নেমে আসবে। আর ন্যূনতম ধাক্কা এলেও ১২টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের হার ৮ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে আসবে।
ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা উত্তরণ করতে না পারলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। ব্যাংকগুলো এখনই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আগাম ব্যব্রস্থা না নিলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এতে এ খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা নষ্ট হবে। যা সামগ্রিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বড় বড় গ্রাহকের কাছে ব্যাংক ঋণ কেন্দ্রেীভূত হয়ে পড়ছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় কমে গেছে। এটাই ঝুঁকির অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। এটা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর যেকোনো প্রকার লেনদেনের সক্ষমতা কমে যাবে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। কাক্সিত হারে ঋণ জাতীয় প্রবৃদ্ধি হবে না।