২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সাাৎকারে সোনালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বছর শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ অঙ্কের ঘরে নামবে

-

আতাউর রহমান প্রধান। ৩৫ বছরের ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের ৩২ বছরই কেটেছে তার সোনালী ব্যাংকে। মধ্যে কর্মসংস্থান ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালনের পর আবারো তিনি সোনালী ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি, অর্থনীতির উন্নয়ন, সরকারি ব্যাংকগুলোর ভূমিকা এবং সোনালী ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি নয়া দিগন্তের সাথে খোলাখুলি আলাপ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন তিনি।
অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবদানের কথা উল্লেখ করে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, গ্রাম থেকে শহরে দেশব্যাপী ১ হাজার ২২৪টি শাখা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এসব শাখার মাধ্যমে সরকারের ৫১টি সেবার মধ্যে ৩৭টি সেবার কোনো ফি অর্থাৎ কোনো সেবা মাশুল নেয়া হয় না। মাত্র ১০ টাকা দিয়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয় একমাত্র সরকারি ব্যাংকেই, যা অন্য ব্যাংকগুলোয় আশাও করা যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে ৮০’র দশক পর্যন্ত যে বড় বড় শিল্পকারখানা ও উদ্যোক্তা শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমেই হয়েছে। অর্থনীতির বিনির্মাণে কৃষকের ঋণ দেয়া হয়েছে। এতে মাঠ থেকে ব্যাংকের টাকা ফেরত আসেনি, কিন্তু সবুজ হয়েছে মাঠ। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠেছে। এ কারণে এক সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষের যেখানে খাদ্য সঙ্কট ছিল, আজ ১৮ কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। তাই সরকারি ব্যাংকগুলোকে ঢালাওভাবে দোষারোপ না করে অর্থনীতিতে এর অন্তর্নিহিত প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৯৬ হাজার কোটি টাকার এলসি খোলা হয়েছে। সোনালী ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে এলসি কমিশন পেতো। কিন্তু ব্যাংকের মালিক যেহেতু সরকার, আর সরকারের কার্যক্রম যেহেতু জনগণের জন্য, সোনালী ব্যাংক তাই সরকারের কাছ থেকে এলসির কোনো কমিশন নেয়নি। অথচ এ ৫ হাজার কোটি টাকার কমিশন পেলে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি অনেকাংশেই কমে যেতো। এভাবেই সোনালী ব্যাংক জনগণের সেবা দিয়ে আসছে।
আতাউর রহমান প্রধান বলেন, অনেকেই বলে থাকেন সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের সেবার মান ভালো। কিন্তু শাখা ও লোকবলের তুলনায় সোনালী ব্যাংকের সেবার মান এখনো অনেক ভালো। এ বিষয়ে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ২৬০টি শাখা পরিচালিত হয় যেখানে ২০ হাজার লোকবল দিয়ে, সেখানে সোনালী ব্যাংকের ইউনিয়ন থেকে শহর পর্যন্ত ১ হাজার ২২৪টি শাখায় লোকবল রয়েছে মাত্র ১৯ হাজার। তা-ও আবার গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন নিয়োগ হয়েছে ৫ হাজার। এর পরেও অনলাইন ও অটোমেশনের মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীর দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। তিনি আশা করেন, শত ভাগ অটোমেশন ও অনলাইন করা হলে, সোনালী ব্যাংকের সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিচালন ব্যয়ও কমে আসবে।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, ১৯৭২ সালে যখন শিল্প ঋণ বিতরণ শুরু করি, তখন আমাদের অভিজ্ঞতাও যেমন কম ছিল, তেমনি শিল্প উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতাও কমছিল। এ কারণে ওই সময় যেসব শিল্পে খেলাপি ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তার বড় একটি অংশ খেলাপি হয়ে যায়। এ দিকেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষককে নানা স্কিমে ঋণ দেয়া হয়, যা ফেরত আসেনি। কিন্তু এতে খাদ্য উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি কৃষিভিত্তিক শিল্পও গড়ে উঠেছে। বেসরকারি ব্যাংকের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই ৮০’র দশকে সোনালী ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা ছিল। সব মিলিয়ে সোনালী ব্যাংকের ওই সময়ে খেলাপি ঋণ বেশি ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত যেসব ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে তা গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করেই ঋণ বিতরণ করা হয়। এ কারণে নতুন ঋণে খেলাপি ঋণ কমে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন চলে আসা পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তার পরেও আমরা খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আগের বছরে যেখানে খেলাপি ঋণের হার ছিল মোট ঋণের প্রায় ২৮ শতাংশ, গত বছর শেষে তা কমে নেমেছে ১৯ শতাংশ। আমরা চলতি বছর শেষে ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে তা সিঙ্গেল ডিজিট, অর্থাৎ এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনা।
সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, গত বছর সোনালী ব্যাংক তিন হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছেন। গত বছর ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ২ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা নিয়মিত করা হয়েছে। আবেদন পড়েছিল ২ হাজার ৮০০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৫৮৫টি। সরকারের এই সিদ্ধান্তে যথেষ্ট সাড়া পাওয়া গেছে।
আতাউর রহমান প্রধান বলেন, শেয়ারবাজার চাঙ্গা রাখতে সোনালী ব্যাংক আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি গত বছর সোনালী ব্যাংকের ১৭৩০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফাকে বিশেষ অর্জন বলে তিনি মনে করেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, পদ্মা ব্যাংকে তার ব্যাংকের বিনিয়োগ দেশের ব্যাংক খাতকে সুরক্ষারই অংশ। করোনাভাইরাসের প্রভাবে চীনের সাথে আমাদের দেশের ব্যবসায় প্রভাব পড়বে বলে তিনি মনে করেন। সোনালী ব্যাংকের ১২২৪টি শাখাই অনলাইনের আওতায় আসায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেবা প্রদান সহজতর হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় বড় অনিয়ম মানুষকে হতাশ করছে। এ ছাড়া হলমার্ক, বিসমিলাহ, বেসিক এবং বর্তমানে জনতা ব্যাংকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে মানুষ আশা দেখে আবার হতাশ হচ্ছেন। বিশেষ করে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান মানুষের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এটা খুব খারাপ খবর। সে কারণে বারবার আস্থা হারিয়ে ফেলছেন সাধারণ মানুষ। এ থেকে উত্তরণে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে সর্বত্র সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই।
সোনালী ব্যাংকের এমডি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলে বেশ কিছু কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। এর মধ্যে জন্মশতবার্ষিকীর ণগণনা উপলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান ফটকে বড় মাপের একটি ঘড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান কার্যালয়ের মূল দরজায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হবে। ব্যাংকের খামসহ সব ধরনের কাগজপত্রে ‘মুজিববর্ষ ২০২০’ লাগানো থাকবে। সারা দেশ থেকে স্বীকৃত কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদেরকে সোনার মেডেল থেকে শুরু করে আর্থিক অনুদান দেয়া হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার নির্মাণে অর্থায়ন করা হবে। মুজিববর্ষ উপলে ইতোমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটি গাড়ি হস্তান্তর করেছি। সোনালী ব্যাংকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মরত এবং অনেকে অবসর নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলে তাদের সবাইকে সম্মাননা প্রদান করবÑ যার মূল্যমান কোনোভাবেই ২৫ হাজার টাকার নিচে নয়। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের প থেকে দেশের বিভিন্ন স্কুল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর জীবনী সম্পর্কে কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হবে এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন চলতি বছরের ১৭ মার্চ সোনালী ব্যাংকে কুরআনখানির আয়োজন করা হবে। সোনালী ব্যাংকের কোটপিনে ৭ মার্চের ভাষণের তর্জনি উন্মোচিত ছবি থাকবে। মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে চলতি বছর ব্যাংকের সব সেবা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছি। এ ছাড়া সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত এলে সে দিকেও গুরুত্বসহকারে নজর দেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement