আয় কমছে বাড়ছে ব্যয়
- এহতেশামুল হক
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
গাজীপুরের বাসিন্দা রহিমা খাতুন, স্বামীর পেনশন হিসেবে পাওয়া পুরো টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন, যা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই সাংসারিক বাজেটে টানাটানি শুরু হয়েছিল। আর চলতি বাজেটে উৎসে কর বাড়িয়ে দেয়ায় তারা পড়েছেন আরো সঙ্কটে। রহিমা খাতুন বলেন, ‘সঞ্চয়পত্রের টাকা আর কিছু জমিজমা থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, সংসার খরচ চলে। এমনিতেই সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েেেছ। বাড়তি করের বোঝা চাপায় সঞ্চয়পত্র থেকে এখন আমাদের আয় আরো কমে গেছে। এখন তার সংসার পরিচালনা করাই দায় হয়ে পড়েছে।
রহিমা খাতুনের মতো অনেকেই পড়েছেন এ বিপাকে। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে গেছে। পুুঁজিবাজারেও অস্থিরতার কারণে অনেকেই মূলধন হারিয়ে ফেলেছেন। অব্যাহতভাবে শেয়ারের দাম কমে যাওয়ায় অনেকেই দিশেহারা হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে অনেকটা নিশ্চিত বিনিয়োগ ছিল সঞ্চয়পত্র। কিন্তু সেই সঞ্চয়পত্রেও বাড়তি করের বোঝা চাপায় সাধারণ মানুষ এখন কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কড়াকড়ি আরোপ ও উৎসে কর বৃদ্ধির কারণে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি হয়েছিল যেখানে ২১ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। যা শতকরা হিসেবে প্রায় ৬৬ শতাংশ কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণেই জুলাই-নভেম্বর মাসে অস্বভাবিক হারে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি।
জানা গেছে, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের জন্য মোটা দাগে দুটি খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। একটি অভ্যন্তরীণ ঋণ, অপরটি বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে একটি ব্যাংকিং খাত থেকে, অপরটি ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে। ব্যাংকবহির্ভূত খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকেই বেশির ভাগ ঋণ নিয়ে থাকে সরকার।
চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
গত অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বিক্রি বাড়তে থাকায় সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঠিক করা হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ মাস জুনে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ২০৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র কেনায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এখন থেকে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে ই-টিন সনদ জমা দিতে হবে। টাকার পরিমাণ এক লাখের বেশি হলে অবশ্যই ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। এ জন্য সঞ্চয়কারীর ব্যাংক হিসাব নম্বর, মোবাইল নম্বর দিতে হবে। এ ছাড়া নতুন ফরম এবং ‘ম্যানডেট’ ফরম সংগ্রহ করে পূরণ করে জমা দিতে হবে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপে গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। যদিও এর আগে এনবিআরের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, সব ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকা অতিক্রম না করলে এই ধরনের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত সুদের ওপর আগের নির্ধারণ করা উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহ করতে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল।
বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মের পর থেকে এই হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।
জানা গেছে, দেশের নারী, বয়স্ক নাগরিক এবং অবসরে যাওয়া সাবেক চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ, তাদের পারিবারিক আয়ের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ, পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে পুঁজিবাজারে অনেকেই বিনিয়োগ করেন না। আবার অবসরপ্রাপ্তদের অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্য বোঝেন না। ফলে তারা ব্যবসায়েও বিনিয়োগ করেন না। অবসরের জীবন অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকার জন্য তাই বেশির ভাগই পেনশনের অর্থ দিয়ে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ করে থাকেন। আবার দেশের ব্যাংকগুলোতেও তুলনামূলকভাবে আমানতের সুদহার কম। কারণ, ব্যাংকগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে চড়া সুদ আদায় করলেও আমানতকারীদের মুনাফা দেয় তুলনামূলক কম। এর কারণ হিসেবে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। ঋণের টাকা ফেরত না দেয়ায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে গেছে। সব ধরনের খেলাপি ঋণসহ ব্যাংকিং খাতে এখন প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ঠেকেছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেছে। এ তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে ঋণের সুদ হার বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বিপরীতে আমানতকারীদের কাক্সিক্ষত হারে মুনাফা দেয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়া অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হন। আনিছা খাতুন বলেন, ‘ব্যাংকে সুদের হার কম। ব্যবসাবাণিজ্য তো আর এই বয়সে করতে পারব না। তাই সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছি, যাতে সহজে মুনাফা পাওয়া যায়। আবার পোস্ট অফিস থেকে তুলতে পারি বলে ঝামেলা হয় না।’ এত দিন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তোলার সময় ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হতো, এখন থেকে তাদের দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে। বাড়তি করের বোঝা বহন করতে গিয়েই তাদের আয় কমে গেছে।
বাজার বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, যেকোনো একটি দেশে মধ্যবিত্তরাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে থাকে সব সময়। বিশেষ করে যখন বাজারে অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ে, আর যখন তাদের আয় কমে তখন ওই মধ্যবিত্ত সমাজই সবচেয়ে বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়ে। কারণ, মধ্যবিত্তরা সমাজের এমন একটি অংশ, যারা চাইলেই তাদের আয় হঠাৎ করে বাড়িয়ে তুলতে পারে না। তাদেরকে মোটামুটি একটি স্থির আয় দিয়েই সংসার চালাতে হয়। ফলে হঠাৎ করে কোনো নোটিশ ছাড়াই বাজারে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন এর আঘাত এসে লাগে মধ্যবিত্ত সমাজের ওপর। আর যখন বাজারে নানা পণ্যের দাম বিনা নোটিশে বেড়ে যায়, তখন সবচেয়ে বেশি কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে এই মধ্যবিত্ত অংশটুকু। সম্প্রতি বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে মধ্যবিত্ত সমাজকে।