২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুঁজিবাজার : প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অন্তরায়

-

নিজের ঘরে টাকা গয়নাসহ মূল্যবান সম্পদ রাখা নিরাপদ মনে করেন না অনেকেই। তাই কষ্টার্জিত মূল্যবান সম্পদ রাখা হয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান হলো আস্থার প্রতীক। যে প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের যত নিরাপত্তা দিতে পারবে অর্থাৎ আস্থার মূর্ত প্রতীক হিসেবে দেখাতে পারবে ওই প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের ভিড় বাড়ে। আর কোনোক্রমে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর একবার আস্থার ফাটল দেখা দিলে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় গ্রাহকেরা। অতীতে এমন অনেক প্রমাণ মিলেছে দেশের আর্থিক খাতে। কয়েক মাস ধরে টানা দরপতন হচ্ছে দেশের বড় আর্থিক খাত পুঁজিবাজারে। রাষ্ট্র ও তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান নানা উদ্যোগ নিলেও পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরাতে পারছে না সাধারণ গ্রাহকের।
গত এক বছরে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অন্যতম উদ্যোগ ছিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থের সংস্থান করা। এর আগে ঋণ আমানতদের অনুপাত সাড়ে ৮৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৯২ হাজার কোটি টাকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড রয়েছে। এ থেকে ব্যাংকগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো তাদের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে না। এমন বিধান আগেই দেয়া রয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রায় ২৩টি ব্যাংকের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ ২৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগসীমা ২৫ শতাংশে আনতে গেলে আলোচ্য ব্যাংকগুলো প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারবে। এ বিনিয়োগ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে তিন মাস সময় দেয়া হয়।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর এক সার্কুলার জারি করেছিল। ওই সার্কুলারে বিনিয়োগসীমা যাদের ২৫ শতাংশ নিচে রয়েছে তাদের রেপোর মাধ্যমে (ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে থেকে ধার নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথমে ২৮ দিনের জন্য, পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ৬ মাস পর্যন্ত এ ধার নিতে পারবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগ ব্যাংকগুলো সাড়া দেয়নি। সার্কুলার জারির এক মাস পার হলেও গতকাল পর্যন্ত মাত্র একটি ব্যাংক এ সুযোগ নিয়েছে। বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক তারা নিজস্ব পোর্টফোলিওয়ের মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিয়েছে। আর কোনো প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত এ সুবিধা নেয়নি।
এ দিকে পুঁজিবাজারের চলমান মন্দা অবস্থায় এক দিকে বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা, অন্য দিকে দুর্দিন নেমে এসেছে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে। খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বেশির ভাগ ব্রোকারেজ হাউজ। ফলে চাকরি হারানোর আতঙ্ক রয়েছেন ব্রোকারেজ হাউজগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ডিএসইর প্রধান সূচক চলতি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল গত ২৪ জানুয়ারি। ওই দিন সূচক ছিল ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে ও বাজার মূলধন ছিল প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। গত ২৪ অক্টোবর সেই সূচক নেমে এসেছে ৪ হাজার ৭৭২ পয়েন্টে। আর বাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার কিছু ওপরে। প্রায় ৫০টি কোম্পানির শেয়ারদর এখন ফেসভ্যালুরও নিচে নেমে গেছে।
হঠাৎ পুঁজিবাজারে এমন কী হলো যে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এটাকে আস্থায় নিতে পারছেন না। এর উত্তর সহজেই পাওয়া যায়। আর তা হলো এর যারা নিয়ন্ত্রণকারী রয়েছেন তাদেরকে আস্থায় নিতে পারছেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে নানা সুবিধা দেয়ার পরেও ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিনিয়োগকারীই এ বাজারমুখী হচ্ছে না। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হয়েও বিএসইসি শেয়ারবাজারের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। কাজেই বিএসইসিকে ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে সরকার যদি বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়, তা হলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। মূলত শেয়ারবাজার কিছু লোকের হাতে এখন জিম্মি। এই জিম্মি দশা থেকে উত্তরণে বিএসইসি ভেঙে দেয়াই একমাত্র পথ। তবে শুধু বিএসইসি ভেঙে দিলেই হবে না, এখানে শক্ত লোককে নিয়োগ দিতে হবে। যারা কোনোভাবেই শেয়ারবাজারে লেনদেনের সাথে যুক্ত থাকবেন না। পাশাপাশি শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) ভেঙে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। তারা বলেন, বিএসইসিকে ভেঙে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এটাকে চেঞ্জ করতে হবে।
একই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন নীতিসহায়তা দিতে হবে। যেমন, বাজারের এ অবস্থা দেখে কেউই ঝুঁকি নিতে চাইছে না। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ হচ্ছে না মূলত মূলধন খোয়ানোর ভয়ে। বেশি মূল্যে শেয়ার কিনে কম মূল্যে বিক্রি করলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ‘কমার্শিয়াল অডিটে’ ধরা হয়। এই ভয়ে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ হচ্ছে না। কমার্শিয়াল অডিটে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে যেসব বিধিনিষেধ আছে, সেগুলো যদি কিছুটা শিথিল করা যায়, তা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাহস নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ বাড়ালে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এ ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল অডিট নীতিমালা একটু শিথিল করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।


আরো সংবাদ



premium cement