আরএমজি-নির্ভর রফতানি খাত কতটুকু নিরাপদ?
- আশরাফুল ইসলাম
- ১৩ মে ২০১৯, ০০:০০
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিকল্প থাকে। আর বিকল্প না থাকলে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। যেমনÑ কারো ডান হাত না থাকলে বাম হাত দিয়ে কাজ চালায়। বাম হাত না থাকলে ডান হাত দিয়ে কাজ চালায়। জীবনের গতি যেন থেমে না যায়, সেজন্য থাকে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা। যার বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা থাকে না, তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। জীবনের গতি থেমে যায়। হয় ছন্দপতন। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই থাকতে হয় বিকল্প ব্যবস্থা।
আবার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমন্বয়ের ব্যবস্থা রাখতে হয়। যেমনÑ কেউ ১০ টাকা আয় করে ১৫ টাকা ব্যয় করলে সে যেমন ঋণগ্রস্ত হয়। আবার ১০ টাকা আয় করে দুই টাকা ব্যয় করলে তার আট টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। যদিও বেশি উদ্বৃত্ত সব সময় ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। কারণ, ব্যয় না করলে আয় বাড়বে না। ব্যয় হলো জীবনের একটি বিনিয়োগ। যেমনÑ কেউ যদি সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনে খায় তাহলে ওই ব্যক্তি যেমন সুস্থ থাকবে, আর সুস্থ থাকলে সে বেশি কাজ করতে পারবে। আর বেশি কাজ করতে পারলে বেশি আয় হবে। এভাবেই ব্যয়ের সাথে আয়ের একটি যোগসূত্র আছে। কিন্তু আয়ের অতিরিক্ত ব্যয় করলে ব্যক্তি যেমন ঋণগ্রস্ত হন, তেমনি বর্ধিত আয় না হলে দৈনন্দিন ব্যয়ের সাথে ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। এতে জীবনের নানা জটিলতা বাড়ে। হয়তো এ কারণেই মনীষীরা বলেছেন, আয় বুঝে ব্যয় করো।
আমাদের জাতীয় জীবনে এক দিকে আমাদের মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ নানা প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা আমদানি করি। এতে প্রয়োজন হয় বৈদেশিক মুদ্রা। আর এ বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের রফতানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যেটুকু বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, পণ্য ও সেবা আমদানিতে ব্যয় হয় তার চেয়ে বেশি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মেটাতে আমরা বৈদেশিক ঋণ করি, বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে গ্রহণ করি নানা অনুদান।
আমাদের আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশের সংস্থান হয় রফতানি আয়ের মাধ্যমে। বিভিন্ন পণ্য রফতানির মাধ্যমে আমরা প্রতি বছর এ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। কিন্তু রফতানির ঝুড়িতে পণ্যের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক নয়। যে কয়েকটি পণ্য রয়েছে, তার মধ্যে রফতানি আয়ে বেশির ভাগই দখল করে আছে তৈরী পোশাক খাতে। রফতানি আয়ের ৮৫ ভাগই আসে এ খাত থেকে। বাকি ১৫ ভাগ আসে বাকি পণ্য থেকে। রফতানি আয়ে তৈরী পোশাক খাতের বিকল্প কোনো পণ্য আজো হয়নি। দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের রফতানি খাত তৈরী পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রফতানির ঝুড়িতে তৈরী পোশাক খাতের বিকল্প কোনো পণ্য না আশায় তাই আমরা সব সময় থাকি উদ্বিগ্নে। এ খাতের ওপর হালকা কোনো ঝড় এলেই আমরা আতঙ্কিত হই, হই শঙ্কিত। নানা অজানা আশঙ্কা আমাদের ওপর ভর করে।
রফতানি আয়ের গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতি বছর যে পরিমাণ রফতানি আয় হয়, তার গড়ে ৮০ শতাংশ আয় হয় তৈরী পোশাক খাত থেকে। যেমনÑ দেশে মোট রফতানি আয়ের ২০১০ সালে ৭৭ শতাংশ, ১১ সালে ৭৮ শতাংশ, ১২ সালে ৭৮ শতাংশ, ১৩ সালে ৭৯ শতাংশ, ১৪ ও ১৫ সালে ৮১ শতাংশ করে, ১৬ সালে ৮২ শতাংশ আয় হয় তৈরী পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছরে আয় হয় সাড়ে ৮৩ শতাংশ এবং গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৮৪ দশমিক ২২ শতাংশ আয় হয়েছে রফতানি খাত থেকে। অর্থাৎ তৈরী পোশাক খাতের রফতানি আয় বাড়লে আমাদের মোট রফতানি আয় বাড়ে, আর এ খাতের কোনো সমস্যা হলে সামগ্রিক রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আবার দেখা যায়, যেসব দেশ আমাদের তৈরী পোশাক ব্যবহার করে তাদের অর্থনীতিতে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লেই বা তাদের দেশে পণ্য বিক্রি করতে মূল্যের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে এ খাতের রফতানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। দেখা যাচ্ছে, আমাদের তৈরী পোশাকের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও কানাডা এই ৯টি দেশ। তথ্যপ্রমাণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য কেনে তার মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরী পোশাক। তেমনিভাবে জার্মানি ৯৫ ভাগ, যুক্তরাজ্য ৯২ ভাগ, ফ্যান্স ৯৩ ভাগ, ফ্রান্স ৯৩ ভাগ, স্পেন প্রায় ৯৫ ভাগ, ইতালি ৮৬ ভাগ, বেলজিয়াম ৮৩ ভাগ, নেদারল্যান্ডস ৮১ ভাগ এবং কানাডা ৮৮ ভাগ তৈরী পোশাক কেনে আমাদের দেশ থেকে। তৈরী পোশাক আমদানিতে এসব দেশের কোনো একটি বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমাদের রফতানি আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ দিকে দেখা যাচ্ছে আমাদের রফতানি ঝুড়িতে যে কয়েকটি পণ্য রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য, কৃষিপণ্য ও হিমায়িত খাদ্য। কিন্তু রফতানি আয়ের যেখানে ৮৫ শতাংশ তৈরী পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল তাই অন্য পণ্যগুলোর বাড়া-কমার সাথে তেমন প্রভাব পড়ে না রফতানি আয়ে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য হতে দেখা যায়, চামড়া ও চামড়াজাত, পাট ও পাটজাত, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের মতো বড় খাতের রফতানি আয় কমে গেছে। ব্যতিক্রম কেবল তৈরী পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য ও হিমায়িত খাদ্য। খাত তিনটির কল্যাণে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রফতানি আয়ে ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তাতে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৯৩ কোটি মার্কিন ডলারে। অথচ চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ১০ মাস শেষে সেই প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশের মতো কমে ১১ দশমিক ৬১ শতাংশ হয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ১০ মাসের মোট পণ্য রফতানির ৮৩ দশমিক ৯৬ শতাংশই তৈরী পোশাক খাতের দখলে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দুই হাজার ৮৪৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই আয় গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দুই হাজার ৫০৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭৯ কোটি ডলারের প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছে। এ ছাড়া আলোচ্য সময়ে ৪৪ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের হিমায়িত খাদ্য রফতানি হয়। হিমায়িত খাদ্যের মধ্যে ৩১ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের চিংড়ি রফতানি হয়েছে। পোশাক রফতানিতে ভালো করলেও দ্বিতীয় শীর্ষ রফতানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ কম। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৬৯ কোটি ডলারের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ কম। হোম টেক্সটাইল রফতানি ৩ দশমিক ৭৪ কমেছে, রফতানি হয়েছে ৭২ কোটি ডলারের পণ্য।
বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমবে না, বরং দিন দিন বেড়ে যাবে। আর এ চাহিদা মেটাতে হলে আমাদের রফতানি আয় বাড়াতে হবে। আর রফতানি আয় বাড়াতে হলে রফতানি ঝুড়িতে নতুন নতুন পণ্য যোগ করতে হবে। বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে ওইসব পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। পোশাক খাতের বিকল্প দাঁড় করাতে হবে। আর এটা না পারলে পোশাক খাতের ওপর কোনো বিপর্যয় এলে আমাদের পুরো অর্থনীতির ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঘুড়ে দাঁড়ানোর মতো আমাদের অবস্থান থাকবে না। এ কারণে সময় থাকতেই বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতি সহায়তা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ছাড় ও প্রয়োজনে প্রণোদনা দিয়ে হলেও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরী করতে হবে। সময়োপযোগী পণ্য রফতানির ঝুড়িতে যুক্ত করতে হবে।