বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট আয়-ব্যয়ের সমন্বয়হীনতায়
- লাবিদ ইসলাম
- ১৩ মে ২০১৯, ০০:০০
মার্কিন ডলারের বিপরীতে কমে যাচ্ছে টাকার মান। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১০ হাজার শতাংশ বা ১০ গুণ। ১৯৭২ সালে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় হতো সাত টাকা ৮০ পয়সা, বছরের পর বছর দাম বেড়ে সেই ডলার পেতে ২০১৮ সালের মে শেষে ব্যয় হচ্ছে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হয়ে পড়ার নানা কারণ রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, যে হারে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি হচ্ছে, ওই পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে না। অর্থাৎ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বেড়েছে, সেই হারে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বা রফতানি আয় বাড়েনি। ফলে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে টাকার মান। বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৭২ সালে প্রতি ডলারের জন্য ব্যয় হতো সাত টাকা ৮০ পয়সা। ১০ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে হয় ১৮ টাকা ৩১ পয়সা। এর পরের ১০ বছরে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে তা আবারো দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৩৬ টাকা ৭৫ পয়সা। এর পাঁচ বছরের মাথায় তা চার টাকা বেড়ে হয় ৪০ টাকা ৮০ পয়সা। এর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ২০০০ সালে তা আরো ১০ টাকা বেড়ে হয় ৫০ টাকা ৮২ পয়সা। ২০০১ সালে ছিল ৫৩ টাকা ৮৪ পয়সা। ২০০৫ সাল শেষে তা আরো বেড়ে হয় ৫৮ টাকা ১১ পয়সা। ২০০৯ সালে তা প্রায় ১০ টাকা বেড়ে হয় ৬৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৪০ টাকা ২০ পয়সা। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় অর্থাৎ গত মে শেষে আরো বেড়ে হয় ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সামনে এ সঙ্কট আরো বাড়তে পারে। কারণ, রেমিট্যান্স প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যয় সেই তুলনায় কমছে না। ফলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এটা হলে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েব পণ্যের মূল্যের ওপর। এতে সাধারণে জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রফতানি আয় বা রেমিট্যান্স বাবদ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পায় তা তাদের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলোর একাউন্ট) আগে জমা হয়। পরে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে জমা ডলারের হিসাব তাদের প্রধান কার্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিটি ব্যাংকের তাদের দিনের লেনদেন শুরুর আগে কী পরিমাণ ডলার রয়েছে (নিট ওপেন পজিশন) তা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানাতে হয়। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রত্যেকটি ব্যাংকেরই বৈদেশিক মুদ্রা কেনা-বেচার একটি কোঠা দেয়া থাকে। ওই কোঠার বেশি ডলার তাদের হাতে থাকলে তা অন্য কোনো ব্যাংক বা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে হবে। ব্যাংক বা গ্রাহককের কাছে বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে তা ওই দিনেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ওই দিনের দরেই ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হয়।
গত কয়েক বছর যাবত ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত ডলার হাতে ছিল।
বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে, তা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজার দরে ডলার কিনে নিয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার হস্তক্ষেপ না করলে প্রতি ডলার পেতে ৬০ টাকার বেশি ব্যয় করতে হতো না। অর্থাৎ শক্তিশালী হতো টাকার মান। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে টাকা শক্তিশালী হয়নি।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর যাবত বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করত।
এদিকে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। হুন্ডি প্রবণতাই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়েও উন্নতি করতে পারছে না। রেমিট্যান্স আনার নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধে মধ্যপ্রাচ্যে তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম পাঠিয়েছে। এর পরও হন্ডি প্রতিরোধ হচ্ছে না। এদিকে রফতানি আয়ও কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে।
সাধারণত কম দামে পণ্য কিনে কম মূল্যে বিক্রি করা যায়। আর উচ্চমূল্যে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। টাকার মান কমে যাওয়ায় আগে যেখানে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত, মান কমে যাওয়ায় একই পণ্য কিনতে হবে ১২০ টাকায়। সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে শিল্পের ওপর। নানা কারণে নতুন শিল্পকারখানা বাড়ছে না। কমে যাচ্ছে শ্রমঘন শিল্প। ব্যবসায়ীরা নানা কারণে ব্যবসায় মার খাচ্ছেন। এর ওপর টাকার মান পড়ে গেলে আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যাবে। আর কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।