০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

ব্যাংক ঋণে খেলাপি সংস্কৃতি

-

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাথে ঋণখেলাপি পরিভাষাটি একাকার হয়ে গেছে। ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। গত কয়েক বছরে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে এর পরিমাণ। গত ছয় মাসে বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এটি হচ্ছে খেলাপি ঋণের অফিসিয়াল চিত্র। এর বাইরে আরো খেলাপি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের প্রায় ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইটঅফ করা হয়েছে। এ ঋণ যোগ করলে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকায়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত বেড়েছিল ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা এবং এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ৭৫১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিশেষ সুবিধায় ২০১৫ সালে পুনর্গঠন করা ঋণের বড় একটি অংশও এখন খেলাপি। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। এ ছাড়া ঋণ বিতরণে অদতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হচ্ছে ঋণ। বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরা দিতে পারছে না ব্যাংক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে কোনো গ্রাহক ঋণ নিয়ে যখন সময় মতো পরিশোধ না করেন তখন সে ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ ঋণ আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক গ্রাহকের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। অর্থঋণ আদালতের ৯০ শতাংশ রায় ব্যাংকের পে আসে। কিন্তু ঋণখেলাপিরা প্রভাবশালী হওয়ায় এবং আইনের দুর্বলতায় সে মামলা হাইকোর্ট বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে রিট করার পর ওই মামলার কার্যক্রম প্রায় স্থগিত হয়ে যায়। উচ্চ আদালতের আদেশ ছাড়া ওই ঋণ আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপরে করার আর কিছুই থাকে না।
এদিকে খেলাপি ঋণ অনাদায়ে সংশ্লিষ্টদের আইনি কৌশলকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে সরকার। পরিস্থিতির উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক খাত-সংক্রান্ত রিট মামলাসমূহের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্ট বিভাগে অন্তত একটি পৃথক বেঞ্চ গঠনের আবেদন জানিয়ে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেনে, ‘মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আর্থিক খাতে রিট মামলার সংখ্যা এবং তাতে জড়িত টাকার পরিমাণ উভয়ই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫ সালে পেন্ডিং রিট মামলার সংখ্যা ছিল চার হাজার ২৫০টি। বর্তমানে সেটি ১৭১৮টি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬৮টিতে।
২০১৫ সালে রিট মামলার সঙ্গে জড়িত টাকার পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে তা ১৫ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকায়। এসব মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা গেলে খেলাপি ঋণ আদায় সহজতর হওয়ার পাশাপাশি ঋণশৃঙ্খলা জোরদার করা যাবে। এর মাধ্যমে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি রোধ, আর্থিক খাত স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালীকরণসহ বিনিয়োগ ও উৎপাদনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, হাইকোর্টে কোনো কোনো খাতের জন্য পৃথক বেঞ্চ থাকলেও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক কোনো বেঞ্চ নেই। ফলে উচ্চ আদালতে ওই মামলাসমূহের নিষ্পত্তি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। একই সঙ্গে পুঞ্জীভূত মামলার সংখ্যা এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মোটেই কাম্য নয়। অবশ্য এর আগেও একই ইস্যুতে আরও দু’দফা আইনমন্ত্রী বরাবর চিঠি লেখেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ওইসব চিঠিতেও কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকি জেনেও বড় ঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৫৭ শতাংশ বড় ঋণে চলে গেছে। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরে বড় ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ হিসাবে, মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ৫৭ শতাংশ বড় ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪০ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬৫, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪৭ এবং বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৭৩ শতাংশ বড় ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫৮ শতাংশ ছিল বড় ঋণ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির পথে বাধা।
বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে পর্যালোচনা করে ২০০৩ সালে টেকসই ব্যাংক খাত গড়ে তুলতে বেশ কিছু সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। কিন্তু সেগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক েেত্র দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা সেই সময়ের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। ওই সময় সংস্থা দুটি বলেছিল, ব্যাংক খাতের বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অনিয়মই চিহ্নিত করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো রোধের মতো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করেছিল তারা। এছাড়া অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধন করে খেলাপি অর্থ আদায়ে ব্যাংকের মতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল সংস্থা দুটি। ঋণখেলাপিরা যাতে উচ্চ আদালত থেকে সাদা হয়ে এসে আবার নতুন করে ঋণ নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেসবের কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে দেশের ব্যাংক খাত ক্রমেই দুরবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


আরো সংবাদ



premium cement
বিপন্ন প্রাণী রক্ষায় নিষ্ঠুরতা বন্ধ করতে হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসছেন ভারতীয় মুসল্লিরা মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে ট্রাকচাপায় অসুস্থ শিশুর মৃত্যু অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান হয়েছে : মুজিবুর রহমান পুলিশ হেফাজতে যুবদল নেতার মৃত্যু : বিচার দাবিতে মানববন্ধন পুতিনের সাথে কথা বলবেন ট্রাম্প পর্দা উঠল অমর একুশে বইমেলার নারী ফুটবল দলের ‘কোচ হটাও’ বিদ্রোহের নেপথ্যে কী রয়েছে? সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না : মন্ত্রিপরিষদ সচিব ৪১ দফা জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী ইশতেহার : হামিদুর রহমান আযাদ নাটোরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে হোটেল কর্মচারীর মৃত্যু

সকল