তাঁত বোর্ডে এক মহাব্যবস্থাপক চাকরি করছেন ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্রে
- শাহ আলম
- ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪৫
অনিয়ম আর সিন্ডিকেটের কারণে দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের তাঁতশিল্প। তাঁতিদের কল্যাণে কাজ করা তাঁত বোর্ড দীর্ঘ দিন ধরে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্যমূল্যে সুতা ও রঙ পাচ্ছেন না তাঁতিরা। ফলে ডুবতে বসেছে দেশের ঐতিহ্যবাসী এ শিল্প। সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি ও বিতরণের পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এ সিন্ডিকেট। এর পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ। পতিত আওয়ামী লীগের সময় অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া কামনাশীষ এখনো আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করছেন। তাঁত বোর্ডেকে রক্ষা করতে কামনাশীষদের সিন্ডিকেট থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে মুক্ত করা সময়ের দাবি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তাঁত বোর্ডে অনিয়ম, দুর্নীতি, কমিশন-বাণিজ্যসহ সুতা, রঙ ও রাসায়নিক দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে সক্রিয় রয়েছেন তিন সদস্যের সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কারণে দেশের তাঁতশিল্প ধ্বংসের পথে। সিন্ডিকেটের মূল সদস্য তিনজন। তাত বোর্ডের জিএম কামনাশীষ দাস। গত ছয় বছরে বোর্ডের তিনবারের অবৈধ এডহক কমিটির তাঁতি প্রতিনিধি মো: মনোয়ার হোসেন ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর এপিএস এমদাদুল হক (দাদু)। এমদাদুল হক এখন পলাতক থাকলেও সিন্ডিকেট এখনো রয়েছে। জিএম কামনাশীষের হাত এতই লম্বা যে, তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সচিব-মন্ত্রীও তার হাতের মুঠোয়। তার বিরুদ্ধে সাধারণ তাঁতিরা শত অভিযোগ দিলেও কাজে আসছে না। এই সিন্ডিকেটের কারণে দেশের তাঁতশিল্প ধ্বংসের পথে। সারা দেশের তাঁতিরা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসের দুর্নীতি ও অনিয়ম শুধু তাঁত বোর্ডেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি যে তাঁত বোর্ডে চাকরি নিয়েছেন সেখানেও ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁত বোর্ডের আগে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে চাকরিরত অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের তাঁতিসমাজ বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ প্রদান, স্মারকলিপি পেশ এবং তদন্ত কমিটি হলেও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন কামনাশীষ দাস। এখন ভুক্তভোগী তাঁতিসমাজ প্রশ্ন তুলছে- জিএম দুর্নীতিবাজ কামনাশীষের খুঁটির জোর কোথায়?
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড রাজশাহীর সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো: ফরহাদ হোসেন স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র দেয়া হয় চেয়ারম্যান বরাবর। অভিযোগপত্রে কামনাশীষ দাসের দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে বলা হয়, কামনাশীষ দাস বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক পদে আবেদন করার সময় নিজেকে সিনিয়র রিসার্চ অফিসার হিসেবে পরিচয় প্রদান করেন এবং তিনি তৎকালীন পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে মিথ্যা এবং ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র নিয়ে ওই আবেদনপত্রের সাথে অভিজ্ঞতার সনদপত্র সংযোজন করেন।
কামনাশীষ দাস বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা পদে ২০০৭ সালে নিয়োগ লাভ করেন এবং ২০১০ সালে ডিপিসি সদস্যদের বিপুল পরিমাণ অর্থ উৎকোচ প্রদান করে বিধিবহির্ভূতভাবে সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন।
দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ রেশম গবেষকরা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক মো: জামাল উদ্দীন শাহ (যুগ্ম সচিব) এক অফিস আদেশের মাধ্যমে কামনাশীষ দাসের সিনিয়র রিসার্চ পদের পদোন্নতি বাতিল করে তাকে গবেষণা কর্মকর্তা পদে প্রত্যাবর্তন করান। কামনাশীষ দাস সিনিয়র রিসার্চ অফিসার পদের পদোন্নতি বহাল রাখার উদ্দেশ্যে বাদি হয়ে সরকার তথা পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিবাদি করে মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং ৮৪৪৪ অব ২০১৩ মামলা দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৫ সালের ১ জুলাই তারিখে মামলাটির রায় ঘোষণা করে। মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক মামলার রায় সরকারের অনুকূলে প্রদান করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেড, চন্দঘোনা, রাঙ্গামাটি জেলার সম্পত্তি তার লালিত বাহিনীকে দিয়ে দখলপূর্বক ওই স্থানের চাকমা, মার্মা উপজাতি এবং প্রভাবশালী স্থানীয়দের কাছে জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা নিয়ে জমি বরাদ্দ প্রদান করায় কর্ণফুলী পেপার মিলস্ লিমিটেড বাদি হয়ে ২০০৯ সালের ১৫ এপ্রিল রাঙ্গামাটি জেলা জজকোর্টে কামনাশীষ দাসের বিরুদ্ধে সিভিল- ১৫৪/০৯ মামলা দায়ের করে। মামলাটি বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলা জজকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, আদালতে বিচারাধীন মামলা দু’টি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসকে প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের পদ থেকে প্রত্যাহার এবং আদালতে বিচারাধীন সরকারি মামলা থাকায় তার সব গোপনীয় তথ্য তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত ১ অক্টোবর বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাষানটেক বেনারসি প্রকল্পের কার্যক্রম দেখতে গিয়েছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে বেনারসি পল্লীর তাঁতিরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। ওই বিক্ষোভ মিছিলে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের মহাব্যবস্থাপক কামনাশীষ দাসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য, স্লোগান ও ব্যানার প্রদর্শিত হয়। উপদেষ্টা ও সচিবের সামনেই তারা অভিযোগ করেন কামনাশীষ দাসের বিরুদ্ধে। তারা বলেন, গত ১২ বছরে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি করেছে কামনাশীষ দাস।
মিরপুর ভাষানটেক প্রকল্পে কামনাশীষ দাসের ঘুষবাণিজ্য সম্পর্কে কথা বলেন ওই এলাকার তাঁতি সমিতির সভাপতি হাজী ছাত্তার। তিনি বলেন, কামনাশীষের মতো খারাপ অফিসার বোধ হয় সরকারের কোনো বিভাগে আর নেই। তাঁত বোর্ডে যত দুর্নীতি হয় তার নেপথ্যে থাকে কামনাশীষ দাস। দুই বছর আগে বেনারসি পল্লীর মধ্যে ৯ বিঘা জমির ওপর মেলার কথা বলে ১৫০ জন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা করে নিয়েছিল কামনাশীষ দাস ও হানিফ নামের একজন ব্যবসায়ী। হানিফ কিছু লোকের টাকা ফিরিয়ে দিলেও কামনাশীষ কাউকে টাকা ফেরত দেননি বলে তিনি অভিযোগ করেন। বলা যায়, অধিকাংশ ব্যবসায়ী তাদের টাকা ফেরত পাননি। সাত্তার বলেন, তাঁত বোর্ডের ৯ বিঘা জমি নামমাত্র ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে তিন/চার লাখ টাকা আত্মসাৎ করছেন জিএম ও ব্যবসায়ী হানিফ। এর আগে তাঁতিদের মধ্যে ৯০০ প্লট দেবে বলে আড়াই কোটি টাকা নেয়া হয়েছিল, সে টাকারও হদিস নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা