ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চাই দেশকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে পারে : ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ জুন ২০২৪, ১৬:১১
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেছেন, ‘ইসলামের ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চাই পারে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বাঁচাতে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শের যথাযথ অনুসরণই মাদকের ভয়াবহতা থেকে আমাদের যুব সমাজকে বাঁচতে পারে। ইসলাম ধর্মের নৈতিক শিক্ষায় পারে আমাদের সমাজ মাদকসহ অপরাধ থেকে বাঁচাতে। কিশোর গ্যাং, খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের পেছনে মাদকের অবৈধ ব্যবসা ও অপব্যবহার অন্যতম কারণ। মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশ তরুণ-যুবসম্প্রদায়। তাই পরিবার থেকে বাবা ও মাকে সন্তানের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে মাদক থেকে দূরে থাকার জন্য।’
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে যুব উন্নয়ন সংসদ, ঢাকার উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস উপলক্ষে মাদকের ভয়াবহতা, যুব সমাজের নৈতিক অধ:পতন ও আজকের বাংলাদেশ শীর্ষক সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথি ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘১৯৮৭ সাল থেকে ২৬ জুন জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে ও যুব উন্নয়ন সংসদ, ঢাকার চিফ কো-অর্ডিনেটর মুহাম্মদ কামাল হোসাইনের সঞ্চালনায় সিম্পোজিয়ামে আরো আলোচনা রাখেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক মহা-পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, বিএসএমএমইউ বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আতিয়ার রহমান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো: সাইফুর রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, প্রফেসর ড. দেওয়ান মো: সাজ্জাদ প্রমুখ।
সিম্পোজিয়ামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক পরিষদের সভাপতি প্রফেসর নূর নবী মানিক।
ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেন, ‘সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী করেছেন সারাদেশে মাদকের অবাধ বিস্তারকে। ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অপরিপূর্ণতা, আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার, যেখানে সেখানে পর্নোগ্রাফির ছড়াছড়ি এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবেই দিন দিন এসব অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা।’
তাদের মতে, মাদকের ভয়াল থাবা পড়ছে তরুণ-তরুণীদের ওপর ফলে ভবিষ্যতের কারিগররা একদিকে যেমন গড়ে উঠছে অনৈতিকতা ও মাদকের ওপর ভর করে, তেমনি কমছে মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতাও। কারণ মাদক ও মাদকাসক্তি হচ্ছে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় যা সেবনের ফলে মস্তিস্ক, যকৃতসহ মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। শুধু তাই নয় মাদকাসক্ত ব্যক্তি তার নিজ জীবন ও তার পরিবারের জীবনও বিপন্ন করে দেয়। এছাড়াও মাদক শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকদের অভিমত।
বিএসএমএমইউ বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আতিয়ার রহমান বলেন, ‘গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ, ধূমপানসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে, তা অনেকেরই অজানা। মাদক সেবন করার কারণে স্মরণশক্তি ও মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। যৌনশক্তি নষ্ট হয় ও সেই থেকে বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় ও যুবক সমাজের মেধা নষ্ট করে দেয়। লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। মাদকের কারণে মেধাহীন প্রজন্ম গড়ে উঠছে আমাদের দেশে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেথামফেটামিন, হেরোইন এবং সিন্থেটিক ওপিওড যেমন বুপ্রেনরফিন এবং ফেনসিডিলের পাচার অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে মাদক আগ্রাসন বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। প্রতি বছর মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে শিশু ও নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে ইয়াবা ছেলেদের মতো মেয়েরাও অবলীলায় গ্রহণ করছে। বিগত ১০ বছরে মাদকাসক্তির কারণে ২০০ মা-বাবা খুন হয়েছেন। ২৪ ধরনের মাদক চলে বাংলাদেশে। দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এসব মাদক। মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক মহা-পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের মৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ। যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ।
মাদকসেবীদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ শতাংশই তরুণ যুবসমাজ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ শতাংশই ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত, যা গবেষণায় প্রমাণিত।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো: সাইফুর রহমান বলেন, ‘পাঁচ শতাধিক মাদকাসক্তের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে তাদের ১৫০ টাকার মাদক লাগে। এ হিসাবে একজন মাদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকার মাদকের জন্য ব্যয় করে। ২৫ লাখ মাদকাসক্ত বছরে ১৩ হাজার কোটি টাকার মাদক সেবন করে। এসব মাদকের পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে আসছে। পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। মিয়ানমারের সাথে মাত্র ২৭১ কিলোমিটারের সীমান্তের সবচেয়ে সক্রিয় মাদক রুটগুলো গোটা দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের দেশের চার শ্রেণির মানুষ মাদক সেবন করে। একটি হলো নিম্নবিত্তের মানুষ। যুব সমাজ যারা হতাশার থেকে মাদক সেবন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং উপরের তলার মানুষ যারা বিভিন্ন ক্লাবে বসে পার্টি করে। জেলখানায় ৯৮ শতাংশ মাদক মামলার আসামি। ৪০ শতাংশ মাদক আবার কেনা-বেচা হয় জেলখানায়। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ মাদকের প্রসার আরো বাড়বে। যে সরকার বেনজির, আজিজ, মতিউরের মতো লোক তৈরী করে, ওই সরকারের সময়ে মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।’
আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস উপলক্ষে মাদকের ভয়াবহতা, যুব সমাজের নৈতিক অধ:পতন ও আজকের বাংলাদেশ শীর্ষক সিম্পোজিয়াম বক্তারা বলেন, মানবতার মুক্তির অগ্রদূত আমাদের আদর্শ আমাদের নেতা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মাদককে সব পাপাচারের চাবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) একবার জনগণকে সম্বোধন করে বলেন, তোমরা মদ্যপান থেকে বিরত থাক, কেননা, এটাই হচ্ছে সমস্ত দুষ্কার্য ও অশ্লীলতার মূল।
তারা আরো বলেন, মা-বাবা সন্তানকে সব সময় ভালোর প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। যদি সন্তান কোনো খারাপ পথে চলে যায়, তাহলে তা থেকে ফিরে আসার জন্য, সন্তানের সঙ্গ দিতে হবে। খারাপ জগতগুলোর মধ্যে ‘নেশা’ একটি। সন্তান যাতে নেশাগ্রস্থ না হতে পারে, তাকে সেই শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানকে ধর্মীয় মূল্যবেধের মাধ্যমে নেশামুক্ত রাখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মা-বাবা।
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা