নিট কেলেঙ্কারিতে শঙ্কা ভবিষ্যত ঘিরে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ জুন ২০২৪, ১৩:৩৬
ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিরাট কেলেঙ্কারি। বিতর্কের ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। চিকিৎসকের পেশায় অযোগ্যরা যুক্ত হলে মানুষের প্রাণের ভরসা কোথায়?
সর্বভারতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট। যারা ভবিষ্যতে চিকিৎসকের পেশায় যুক্ত হতে চান তাদের এই পরীক্ষায় বসতে হয়। গত ৪ জুন যখন লোকসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে সারা দেশে হইচই, ওই সময় খানিকটা নীরবে প্রকাশিত হয় নিট এর ফল।
ফল ঘিরে বিতর্ক এবার এই পরীক্ষায় ৬৭ জন প্রথম স্থান অধিকার করায় বিতর্ক শুরু হয়। পরে জানা যায়, বেশ কিছু সংখ্যক পরীক্ষার্থীকে বেশি নম্বর দেয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র ও কয়েকটি পরীক্ষা কেন্দ্রে সময়জনিত সমস্যার জন্য বাড়তি নম্বর দেয়া হয় এক হাজার ৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীকে।
র্যাঙ্কিং নিয়ে এই গরমিল প্রকাশ্যে আসতেই বাড়তি নম্বর ঘিরে বিতর্ক দানা বাধে। এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ জানান বিভিন্ন স্তরের মানুষজন ও সংগঠন।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয় বিরোধী রাজনৈতিক দল। ১৪ জুন নিটের ফল বেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু তার ১০ দিন আগেই ফল প্রকাশ করা হয়। সেই অনুযায়ী কাউন্সেলিংয়ের দিন ইতোমধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। আদালতে এ নিয়ে মামলা হলেও কাউন্সেলিং এর প্রক্রিয়ায় বাধা পড়েনি। সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার ওই প্রক্রিয়ার ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেনি।
কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে আগেই জানিয়েছে, নিটে ‘বাড়তি নম্বর' পাওয়া পরীক্ষার্থীদের নম্বর বাতিল করা হবে। বদলে তাদের ফের একবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ দেয়া হবে।
বিচারপতিরা জানান, কাউন্সেলিং পূর্ব ঘোষিত সময় মেনেই চলবে। পরীক্ষা নতুন করে হলেও তাতে বাধা পড়বে না।
বিরোধীদের আক্রমণ এনডিএ সরকার আরেক দফায় সদ্য ক্ষমতায় বসেছে। সামনেই সংসদের অধিবেশন। তার আগে সরকারের বিরোধিতা করার জোরালো একটা ইস্যু হাতে পেয়ে গিয়েছে বিরোধীরা।
কংগ্রেস নিট পরীক্ষা নিয়ে এনডিএ সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেছে৷ এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর 'নীরবতা' নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে রাহুল গান্ধীর দল।
বিরোধী দল দাবি তুলেছে, সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে ফরেনসিক তদন্ত লক্ষ লক্ষ ছাত্রের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারে।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নিট কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।১১ খাড়গের বক্তব্য, ‘আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, কিভাবে দুর্নীতি হয়েছে ৷ ছাত্রদের বিভ্রান্ত করা ঠিক নয়। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে জনসাধারণকে বোকা বানানো অনুচিত।’
কংগ্রেস নেতা পবন খেরা এই দুর্নীতিকে ব্যাপম এর দ্বিতীয় পর্ব বলে আখ্যা দিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশে ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে বিপুল টাকার দুর্নীতি হয়েছিল বলে অভিযোগ।
যদিও নম্বর বৃদ্ধির কেলেঙ্কারি খারিজ করেন, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান। এই বছর শীর্ষ স্থান প্রাপ্তের সংখ্যা কেন বেশি বা কাট অফ মার্ক কেন বাড়ানো হয়েছে, তার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন প্রধান।
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আগের বছরগুলোতে নিট সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হয়নি ৷ এই বছর আমরা রাজ্য বোর্ডের সিলেবাসের সাথেও প্রশ্নপত্র সঙ্গতিপূর্ণ করেছি৷ এবার বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী থাকার ফলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত অনেকে শীর্ষ স্থানে পৌঁছেছে৷’
শিক্ষামহলে প্রশ্ন ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় যদি অযোগ্যরা ঢুকে পড়ে, তার পরিণতি কী হবে এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। চিকিৎসকের পেশার ক্ষেত্রে উন্নত মেধা সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু নম্বর বাড়িয়ে যদি অযোগ্যদের পরের ধাপের পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেয়া হয় বা তাদের নিয়োগের রাস্তা পরিষ্কার করা হয়, তার পরিণতি যে ভালো হবে না, এ ব্যাপারে সবাই একমত।
মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক ডা. বিপ্লব চন্দ্র বলেন, ‘সারা দেশ জুড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনের চাপে নতিস্বীকার করেই কেন্দ্র সরকার সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জারি করে বলেছে যে, এক হাজার ৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীর গ্রেস নম্বর বাতিল করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই আন্দোলনের একটা আংশিক জয়।
তবে, যেখানে পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, ফলপ্রকাশ সবটাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, সেখানে গ্রেসমার্ক বাতিলের বিষয়টি সামগ্রিক দুর্নীতিকে চাপা দেয়ার একটা মরিয়া প্রয়াস।’
বিভিন্ন রাজ্যে ডাক্তারের প্রবেশিকা পরীক্ষা ছিল, সেখানেও এমন দুর্নীতির কথা মাঝেমধ্যে শোনা গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়।
সে কথা মনে করিয়ে সাবেক জয়েন্ট এন্ট্রান্স রেজিস্ট্রার বুদ্ধদেব দাস বলেন, ‘নিট আজ না হয় কয়েক বছর হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স ছিল, তখন দুর্নীতি হয়েছিল ব্যাপক আকারে। এখানে মেরিট লিস্ট যিনি প্রকাশ করতেন, তিনি একজন পার্ট টাইম অফিসার ইনচার্জ। তার আমলেই জয়েন্ট জালিয়াতি হয়েছে।’
ভবিষ্যতের মুন্নাভাই নিট কেলেঙ্কারির মধ্যে বলিউডের একটি ছবির কথা বারবার ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসছে। ভারতে ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ ছবিটির কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে। রাজকুমার হিরানি পরিচালিত এই ছবিতে দেখানো হয়েছে, কিভাবে অসৎ উপায়ে মুন্নাভাই ওরফে অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত মেডিক্যাল এন্ট্রান্সে উত্তীর্ণ হচ্ছেন।
এটা তো সেলুলয়েডের গল্প। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটলে বিষয়টা যে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, তা ভেবে অনেক চিকিৎসকে শিউরে উঠছেন। এই মুন্নাভাইদের হাতেই কি থাকবে ভবিষ্যত চিকিৎসার ভার?
ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমরা ডাক্তাররা বিস্মিত, হতভম্ব ও ক্রুদ্ধ। শুধু ডাক্তার নয়, একই প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষেরও। আগে বিভিন্ন রাজ্যে যখন প্রবেশিকা পরীক্ষা নেয়া হত, তখনো ছোট ছোট দুর্নীতি দেখা যেত। কিন্তু এখন পরীক্ষা কেন্দ্রীকরণ করার ফলে ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে।’
এর নেপথ্যে সর্বোচ্চ স্তরের মদত দেখতে পাচ্ছেন ডা. দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘শুধু যারা গ্রেস মার্ক পেয়েছে, তাদের তাদের সন্দেহ করলেই হবে না। অনেকে প্রায় ফুল মার্কস পেয়েছে পরীক্ষায়। সুতরাং দুর্নীতি হয়েছে ব্যাপক আকারে। এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একটা সংগঠিত অপরাধ।’
সূত্র : ডয়েচে ভেলে