২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে না কেন?

রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশ যথেষ্ট আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে না কেন? - ছবি : সংগৃহীত

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়ার পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও সঙ্কট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আগ্রহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বরং ফিকে হয়ে আসছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সঙ্কট।

রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের কয়েক বছরের মধ্যেই মিয়ানমারে আবারো সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। যদিও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী সবসময়ই সবকিছু পরিচালনা করেছে। সামরিক সরকার এখন মিয়ানমারে গণতন্ত্র-পন্থী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমন পীড়ন চালাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এতো কিছুর পরেও মিয়ানমার কিংবা দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো কেন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারছে না? এর বড় কারণ হচ্ছে, মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দেশটির কৌশলগত গুরুত্ব।

চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক বেশ ভালো। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জোট আসিয়ানের সদস্য মিয়ানমার। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথেও মিয়ানমারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দেশ- চীন ও রাশিয়া কখনোই মিয়ানমারের বিপক্ষে যায়নি। চীনের সাথে মিয়ানমারের ব্যাপক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। আমেরিকার হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে মিয়ানমারের ওপর চীনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি।

মিয়ানমারে অবকাঠামো এবং জ্বালানি খাতে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ আছে। তাছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে মিয়ানমার।

দশকের পর দশক ধরে অর্থনৈতিক স্বার্থে চীন কখনো মিয়ানমারের সরকারের বিপক্ষে যেতে চায়নি। দেশটিতে যা কিছু ঘটুক না কেন বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে চীন সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেনি।

আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেবার পরবর্তী এক বছরে দেশটি ৩৮০ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ অনুমোদন করছে। এর মধ্যে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয় করে একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস প্লান্ট করবে চীন।

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় রাখাইন রাজ্যের তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে একটি জ্বালানি করিডোর স্থাপনের পরিকল্পনা আছে।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, আমেরিকার সাথে চীনের যদি কোনো সংঘাত হয়, তাহলে তারা মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেবে। এটা চীন জানে। তখন তারা তেল ও গ্যাসের সরবরাহ কোথায় পাবে? চীন প্রচুর তেল-গ্যাস আমদানি করে। সেটা মিয়ানমার দিচ্ছে আকিয়াব বন্দরের মাধ্যমে। পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন তেল-গ্যাস নিতে পারছে।

এসব কারণে মিয়ানমারের প্রতি চীনের সমর্থন এবং সহানুভূতি আছে বলে কবির উল্লেখ করেন।

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আসিয়ান জোট মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি। সেটিরও বড় কারণ ব্যবসায়িক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এই অঞ্চলে সবচেয়ে কার্যকরী অর্থনৈতিক জোট হচ্ছে আসিয়ান।

আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর মিয়ানমারে শীর্ষ বিনিয়োগকারী। তাদের অনুমোদিত বিনিয়োগরে পরিমাণ প্রায় দু’হাজার ৪০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ মিয়ানমারে যত বিদেশি বিনিয়োগ আছে তার এক-চতুর্থাংশ হচ্ছে সিঙ্গাপুরের।

এছাড়া জাপান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকেও বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে মিয়ানমার সরকারের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। যদিও সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেবার পর বিদেশী বিনিয়োগ সার্বিকভাবে কমেছে।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের প্রতি জাপানেরও এক ধরনের সমর্থন আছে।

জাতিসঙ্ঘের মিয়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ টমাস এন্ড্রুস সম্প্রতি বলেন, চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে।

সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান টমাস এন্ড্রুস সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেন, চীন ও রাশিয়ার পাশাপাশি সার্বিয়াও মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অস্ত্র দিচ্ছে, যদিও তারা জানে যে এসব অস্ত্র বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।

মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে গত বছর একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। চীন ও রাশিয়া এ প্রস্তাবে ভোট দান থেকে বিরত ছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন শীর্ষ কূটনীতিক জোসেপ বোরেল বলেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো চীন ও রাশিয়ার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে বিভিন্ন দেশ যখন ব্যাপক সরব ছিল তখন মিয়ানমারকে নিয়ে চীন এবং রাশিয়া কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বরং মিয়ানমারের সাথে এ দুটি দেশ বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে তারা কখনো মিয়ানমারের নিন্দা করেনি।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমারের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তৈরি হয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে।

ভারতের সাথে মিয়ানমারের প্রায় এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত আছে। এছাড়া বঙ্গোবসাগরেও উভয় দেশের সীমান্ত রয়েছে। ভারত ও মিয়ানমার ১৯৫১ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন হলেও ভারত কড়াভাবে সেটির নিন্দা করতে পারেনি।

মিয়ানমারে বিভিন্ন সময় দমন-পীড়ন নিয়ে ভারত উদ্বেগ জানালেও তারা শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। সঙ্কটের শুরুর দিকে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যত প্রস্তাব এসেছিল সেগুলোতে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত।

ভারতের সাথে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে। অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আছে মিয়ানমারে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ এবং বিভিন্ন বিরল প্রাকৃতিক পদার্থ ভারতের তথ্য প্রযুক্তি খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া মিয়ানমারের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মিয়ানমার হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগকারী।

তাছাড়া ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যাতে মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য দু‘দেশের মধ্যে একটি চুক্তিও রয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের আশঙ্কা চীনকে নিয়ে। চীন যদি মিয়ানমারে একক আধিপত্য পেয়ে যায় তাহলে মিয়ানমারকে ব্যবহার করে তারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই ভারত মিয়ানমারের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, মিয়ানমার ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলো শক্ত অবস্থানে আছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং তাদের কর্মকর্তাদের ওপর আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো কিছু নিষেধাজ্ঞা দিলেও এর চেয়ে বেশি কার্যকরী কিছু তারা করতে পারেনি।

এর পেছনেও একটি দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারকে পুরোপুরি ছেড়ে দিতে চায় না।

২০১১ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর পশ্চিমা ব্যবসায়ীরা দেশটিতে ভিড় করতে শুরু করে। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের দিকই তাদের নজর ছিল।

জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, হোটেল, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছিল পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। দেশটির মোট জিডিপির ছয় শতাংশ হয়েছিল বিদেশি বিনিয়োগ।

ইউরোপিয়ান কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে দেয়া তথ্যে বলা হয়- চীন, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের পরে মিয়ানমারের চতুর্থ ব্যবসায়ী-অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। উভয় পক্ষের মধ্যে বছরে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য হয়।

সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর নরওয়ের টেলিনরও বিনিয়োগ করেছিল। যদিও ২০২১ সালে সামরিক শাসন পুনরায় ফিরে আসার পরে টেলিনর তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি লেবাননের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে মিয়ানমার ত্যাগ করে।

মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় আয় আসে তেল গ্যাস বিক্রি থেকে। তাদের রাজস্ব আয়ের অর্ধেক আসে এই খাত থেকে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীরা দেশটির তেল-গ্যাস ফান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবার দাবি তুলেছিলে। কিন্তু পশ্চিমা কোম্পানিগুলো এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়তো চাইলে মিয়ানমারের ওপর বাণিজ্যিক অবরোধ দিতে পারে। কিন্তু সেটা তারা দিচ্ছে না।

কবির বলেন, ‘আমার ধারণা এটা তারা দিচ্ছে না, কারণ এটা দিলে সাধারণ মানুষ বেকায়দায় পড়বে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement