আইএস বধূ শামীমা বেগমকে সিরিয়ায় পাচার করে কানাডার এক গুপ্তচর
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩১ আগস্ট ২০২২, ২৩:৩৪
ইসলামিক স্টেট উগ্রবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শামীমা বেগমকে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থার এক গুপ্তচর সিরিয়ায় পাচার করেছিলেন।
বিবিসি এমন কিছু নথি দেখেছে, যাতে ওই গুপ্তচর দাবি করেছেন, তিনি শামীমা বেগমের পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য কানাডাকে জানিয়েছিলেন এবং আরো ব্রিটিশ নাগরিককে ইসলামিক স্টেটের হয়ে লড়াই করার জন্য পাচার করেছেন।
ইসলামিক স্টেটে যোগ দেয়ার জন্য সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল। তার আইনজীবীরা ব্রিটিশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বলেন, শামীমা বেগম পাচারের শিকার হয়েছিলেন।
কানাডা ও যুক্তরাজ্য সরকার এই বিষয়টি নিরাপত্তা সংক্রান্ত বলে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
পূর্ব লন্ডনের তিন স্কুল ছাত্রী শামীমা বেগম, খাদিজা সুলতানা ও আমিরা আবাসি ২০১৫ সালে সিরিয়ায় পালিয়ে যান ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীতে যোগ দেয়ার জন্য। ওই সময় শামীমা বেগমের বয়স ছিল ১৫ বছর। অপর দু‘জনের বয়সও ছিল যথাক্রমে ১৬ এবং ১৫।
ইস্তাম্বুলের প্রধান বাস স্টেশনে তাদের সাথে মোহাম্মদ আল রশিদ নামের এক ব্যক্তির দেখা হয়, যিনি তাদের সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেতে সাহায্য করেন।
মোহাম্মদ আল রশিদ যখন এভাবে সিরিয়ায় লোকজনকে পাচার করছিলেন, তখন তিনি কানাডার একটি নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য পাঠাতেন। বিবিসির কাছে এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন একজন ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি ইসলামিক স্টেটকে দমনের জন্য একটি আন্তর্জাতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত এক সংস্থায় কাজ করেন।
বিবিসি মোহাম্মদ আল রশিদের ওপর একটি নথি সংগ্রহ করে, যাতে তার ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংগৃহীত তথ্যই শুধু নয়, তার কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভ থেকে সংগৃহীত তথ্যও রয়েছে। কিভাবে তিনি কাজ করতেন, তার বিশদ একটা ধারণা পাওয়া যায় এসব তথ্য থেকে।
মোহাম্মদ আল রশিদ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, তিনি যাদের সিরিয়ায় পাচার করতে সাহায্য করতেন, তাদের তথ্য আবার জর্দানে কানাডার দূতাবাসের হাতে তুলে দিতেন।
শামীমা বেগমকে সিরিয়ায় পাচারের কয়েক দিনের মধ্যেই তুরস্কে মোহাম্মদ আল রশিদকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তিনি তুরস্কের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, শামীমা বেগম যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করছিলেন, তিনি সেটির একটি ছবি শেয়ার করেছেন।
লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ যখন শামীমা বেগমের সন্ধান করছিল, ততদিনে কানাডার নিরাপত্তা সংস্থার হাতে শামীমা বেগমের পাসপোর্টের বিস্তারিত তথ্য চলে গেছে। তবে শামীমা বেগমও ততদিনে সিরিয়ায় পৌঁছে গেছেন।
ওই নথি থেকে দেখা যায়, শামীমা বেগমকে সিরিয়ায় পাচারের সাথে যুক্ত ছিল ইসলামিক স্টেটের পাচার নেটওয়ার্কের একটি বড় অংশ। এটি নিয়ন্ত্রিত হতো ইসলামিক স্টেটের রাজধানী বলে কথিত রাকা থেকে।
মোহাম্মদ আল রশিদ ছিলেন ওই নেটওয়ার্কের তুরস্কের দিকের অংশের সাথে যুক্ত। শামীমা বেগম ও তার দু’বান্ধবীকে সাহায্য করার আট মাস আগে থেকেই তিনি ব্রিটিশ নারী-পুরুষ-শিশুদের সিরিয়ায় পাচারের সাথে যুক্ত ছিলেন।
বিবিসি সম্প্রচার করতে যাচ্ছে এমন একটি পডকাস্ট 'আই এম নট এ মনস্টার'-এ কথা বলেন শামীমা বেগম। সেখানে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ আল রশিদ তুরস্ক হতে সিরিয়া পর্যন্ত যাওয়ার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে দিয়েছিল.. আমার মনে হয় না পাচারকারীদের সাহায্য ছাড়া কারো পক্ষে সিরিয়ায় যাওয়া সম্ভব ছিল। উনি আরো বহু মানুষকে আসতে সাহায্য করেন... তিনি আমাদের যা যা করতে বলেছিলেন, আমরা তাই করছিলাম। কারণ তিনি সব জানতেন, আমরা তো কিছু্ই জানতাম না।’
মোহাম্মদ আল রশিদ যাদেরকে সাহায্য করেছিলেন, তাদের সব তথ্য তিনি সংরক্ষণ করতেন। তাদের পরিচয়পত্রের ছবি তুলে রাখতেন, অনেক সময় গোপনে ফোনে তাদের ভিডিও রেকর্ড করতেন। একটি রেকর্ডিংএ দেখা যায়, শামীমা বেগম এবং তার বান্ধবীরা সিরিয়ার সীমান্তের কাছে একটি ট্যাক্সি থেকে বেরুচ্ছেন, এরপর অপেক্ষমান গাড়িতে উঠছেন।
মোহাম্মদ আল রশিদ ইসলামিক স্টেট সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করতেন। সিরিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যেসব যোদ্ধা গিয়েছিল, তারা যেসব বাড়িতে থাকতো ম্যাপে সেগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করতেন। এছাড়া ইন্টারনেটের আইপি অ্যাড্রেস ও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় যেসব ইন্টারনেট ক্যাফে আছে, সেগুলো খুঁজে বের করতেন। আইএস যোদ্ধাদের সাথে তার যে কথা চালাচালি হতো, সেগুলোরও স্ক্রিনশট তুলে রাখতেন।
একটি রেকর্ডে দেখা যায়, মোহাম্মদ আল রশিদ এমন একজনের সাথে কথা বলেন, যিনি এক কুখ্যাত ব্রিটিশ আইএস যোদ্ধা রাফায়েল হোস্টে, যে তাকে বলেছিল, ‘আমি চাই তুমি আমাদের সাথে কাজ করো। আমি চাই তুমি আমাদের হয়ে লোকজনকে এখানে আনতে সাহায্য করো।’
এর জবাবে মোহাম্মদ আল রশিদ লেখেন, ‘ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করতে পারেন?’
এরপর রাফায়েল হোস্টে জবাব দেন, ‘এখন যা করছো, সেটাই করবে। কিন্তু তুমি আমাদের হয়ে কাজ করবে। আমাদের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে আসবে, আমাদের ভাই-বোনদের এখানে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।’
মোহাম্মদ আল রশিদ উত্তর দেন, ‘ভাই, আমি প্রস্তুত আছি।’
শামীমা বেগমকে পাচারে সাহায্য করার কিছুদিনের মধ্যেই মোহাম্মদ আল রশিদ তুরস্কের সানলিউরফা শহর থেকে গ্রেফতার হন। এক বিবৃতিতে আল রশিদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানিয়েছিলেন, তিনি শামীমা বেগমসহ যাদেরকে পাচারে সহযোগিতা করেন, তাদের সবার তথ্য তিনি সংগ্রহ করতেন। কারণ এসব তথ্য তিনি জর্দানে কানাডার দূতাবাসে পাঠাচ্ছিলেন।
রশিদ আরো বলেন, ২০১৩ সালে তিনি জর্দানে কানাডার দূতাবাসে গিয়েছিলেন আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন জানানোর জন্য। তিনি বলেন, তখন ওরা বলেছিল, আমি যদি আইসিসের তৎপরতার খবর সংগ্রহ করে দিতে পারি, তারা আমার আবেদন মঞ্জুর করবে।
তিনি যে ২০১৩ সাল হতে ২০১৫ সালের মধ্যে কয়েকবার জর্দানে আসা যাওয়া করেছেন, তা বিবিসি নিশ্চিত করতে পেরেছে।
শামীমা বেগমের আইনজীবী তাসনিম আকুঞ্জি বলেন, নভেম্বরে শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব বাতিল চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা আবেদনের শুনানি হবে। তখন তাদের একটি প্রধান যুক্তি হবে, শামীমা বেগম যে পাচারের শিকার হয়েছিলেন, সেটি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বিবেচনায় নেননি।
আকুঞ্জি বলেন, ‘এটা হতবাক হওয়ার মতো ব্যাপার যে, কানাডার একটি ইন্টেলিজেন্স সংস্থার কেউ একটি পাচার অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্রিটিশ শিশুদের একটি যুদ্ধাঞ্চলে পাচারের পরিবর্তে যার কিনা আমাদের মিত্র হওয়ার কথা, আমাদের লোকজনকে সুরক্ষা দেয়ার কথা।’
শামীমা বেগমকে এখন উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার এক বন্দী শিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। ইসলামিক স্টেটের তথাকথিত খেলাফত ধসে পড়ার পর যখন শামীমা বেগম প্রকাশ্যে আসেন, তখন ব্রিটিশ সরকার ২০১৯ সালে তার নাগরিকত্ব বাতিল করে।
কানাডার নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একজন মুখপাত্র বলেন, তাদের সংস্থার তদন্ত, কার্যক্রম, কার্যপদ্ধতি বা তৎপরতা সম্পর্কে তিনি প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না, কোনো কিছু স্বীকার বা অস্বীকারও করতে পারছেন না।
ব্রিটিশ সরকারের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতি হচ্ছে নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম বা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করা।’
সূত্র : বিবিসি