রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : দেশত্যাগী ধনী রুশরা দুবাইতে কিনছেন বিলাসবহুল বাড়ি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৫ মে ২০২২, ২২:৫০
ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে রাশিয়া থেকে ধনী লোকজন দলে দলে বেরিয়ে গিয়ে হাজির হচ্ছেন দুবাইতে।
দুবাইয়ের ব্যবসায়িক নেতারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, রুশ বিলিওনেয়ার এবং উদ্যোক্তারা অভূতপূর্ব সংখ্যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেছেন।
এর ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দুবাইয়ের ভূসম্পত্তির দাম ৬৭ শতাংশ বেড়েছে বলে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে।
আমিরাতের সরকার রাশিয়ার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি এবং ইউক্রেনের ওপর হামরা চালানোর জন্য ক্রেমলিন সরকারের প্রতি কোনো নিন্দাও জানায়নি।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েননি এমন রুশদের তারা ভিসা দিচ্ছে, যদিও অনেক পশ্চিমা দেশেই এদের ভ্রমণ সীমিত করা হয়েছে।
এক হিসেব অনুযায়ী, গত দুই মাসে হাজার হাজার রুশ দেশত্যাগ করেছেন। তবে এদের সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি।
একজন রুশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম ১০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ দুই লাখ রাশিয়ান নাগরিক দেশের বাইরে চলে গেছেন।
ভার্চুওজোন নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের প্রধান কাজ দুবাইয়ে বিদেশীদের ব্যবসা চালু করার কাজে সহায়তা করা, তারা জানিয়েছে যে তাদের রুশ ক্লায়েন্টের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রুশদের কাছ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’ বলছেন ভার্চুওজোনের প্রধান নির্বাহী জর্জ হোজেইজ।
‘তাদের প্রধান শঙ্কা হচ্ছে (যুদ্ধের কারণে) রাশিয়ার অর্থনীতিতে ধস নামতে পারে। সে কারণে এরা তাদের অর্থ ও সহায়-সম্পত্তি রাশিয়া থেকে বের করে আনতে চাইছেন।’ বলছেন তিনি।
দলে দলে রাশিয়ান নাগরিক হাজির হওয়ায় দুবাই শহরের বিলাসবহুল ভিলা এবং অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা বেড়ে গেছে।
এরা ওই শহরে বাড়ি কিনতে চাইছেন বলে সম্পত্তির দামও হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে বলে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট বা জমির দালালরা বলছেন।
দুবাই-ভিত্তিক একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বেটারহোমস জানাচ্ছে, ২০০২ সালের প্রথম তিন মাসে রুশ মালিকানায় সম্পত্তি ক্রয় বেড়েছে দুই তৃতীয়াংশ।
অন্য একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি মডার্ন লিভিং বিবিসিকে বলেছে, চাহিদা বাড়ার কারণে তাদের কোম্পানিতে রুশ-ভাষী এজেন্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী থিয়াগো ক্যালাডাস বলছেন, তারা অনেক রাশিয়ান নাগরিকের কাছ থেকে ফোন কল পাচ্ছেন যারা অতি দ্রুত দুবাইতে চলে আসতে চান।
‘মেধা পাচার’
অনেক বহুজাতিক সংস্থা এবং নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও তাদের কর্মচারীদের দুবাইয়ে সরিয়ে আনছেন।
ফুয়াদ ফাতুল্লেভ ‘উইওয়ে’ নামে একটি ব্লক-চেইন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক। রাশিয়া এবং ইউক্রেনে তাদের অফিস ছিল।
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ও তার পার্টনার তাদের শত শত কর্মচারীকে দুবাইয়ে সরিয়ে আনেন।
‘আমাদের ব্যবসার ওপর এই যুদ্ধের শোচনীয় প্রভাব পড়েছে।’ বলছেন তিনি, ‘আমরা আর আগের মতো কাজ করতে পারছিলাম না। সেজন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেন, এই দুই দেশ থেকেই আমাদের কর্মীদের সরিয়ে নিতে হয়েছে।’
ফুয়াদ ফাতুল্লেভ একজন রুশ নাগরিক।
তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বেছে নিয়েছেন-এই জন্য যে সেখানে ব্যবসা চালানোর জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ রয়েছে, বলছিলেন তিনি।
ফাতুল্লেভ জানান, নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে তারা কোনো কাজই করতে পারছেন না। সে জন্যই তারা দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে ব্যবসা করছে যে সব রুশ প্রতিষ্ঠান তাদের সমস্যা আরো বেশি, বলছেন তিনি।
কারণ, পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়া-ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছে।
গোল্ডম্যান স্যাক্স, জেপি মর্গান কিংবা গুগলের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানও তাদের কিছু কিছু কর্মচারীকে দুবাইয়ে সরিয়ে নিয়েছে।
‘সত্যিই এখান থেকে মেধা পাচারের ঘটনা ঘটছে। অনেক লোক ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে-কারণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কাজ করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’ বলছেন ফাতুল্লেভ।
রিয়েল এস্টেট বাজারে ঊর্ধ্বমুখী দর
বিদেশের ব্যাংকগুলোতে রাশিয়ার যে শত শত কোটি ডলার গচ্ছিত রয়েছে, নিষেধাজ্ঞার জন্য রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা তুলতে পারছে না।
সুইফট ফিননিশয়াল সিস্টেম থেকেও কিছু রুশ ব্যাংককে বাদ দেয়া হয়েছে।
নিজের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল রক্ষা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছে যে কোনো রুশ নাগরিক ১০ হাজার ডলারের বেশি নগদ অর্থ নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে পারবে না।
নগদ অর্থ সরাতে না পেরে অনেক ধনী রুশ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে মূল্য পরিশোধ করছে।
দুবাইতে যারা ভিলা বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনছেন তাদের জন্য কাজ করছে বেশ কয়েকটি মধ্যস্বত্বভোগী প্রতিষ্ঠান।
এরা রাশিয়ায় মূল খদ্দেরের কাছ থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ জমা নেয় এবং দুবাইয়ে প্রপার্টি মালিককে নগদ অর্থে সেই মূল্য পরিশোধ করে।
রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য পশ্চিমা দেশগুলো যে অনুরোধ জানিয়েছিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা সৌদি আরবের মতো দেশ সেটা নাকচ করেছে।
ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা জানিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে ভোট হয়েছে চীন এবং ভারতের মতো আবুধাবিও তাতে ভোটদানে বিরত থেকেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে রাশিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করার ওপর গত ৭ই এপ্রিল যে ভোট হয়েছে তাতেও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোট দানে বিরত থেকেছে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক অপরাধের ওপর নজর রাখে যে প্রতিষ্ঠান সেই ফিনানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) আমিরাতের নাম 'ধুসর তালিকা'য় ফেলার পরের মাস থেকে সে দেশে রুশ বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করে।
এর অর্থ হলো অর্থ পাচার এবং সন্ত্রাসে অর্থ জোগানোর বিষয়ে দেশটির ওপর নজরদারি আরো বাড়বে।
তবে ইউএই'র সরকার বলছে, এধরনের বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণের জন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
এবং এসব ব্যবস্থা যাতে আরও জোরদার করা যায় সেজন্য তারা এফএটিএফ-কে সহযোগিতা করবে।
সূত্র : বিবিসি