সারা দুনিয়ায় কেন এই লাগামহীম মূল্যবৃদ্ধি?
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:১১, আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:২২
বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা ইতোমধ্যেই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার এ মুহূর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ। বিগত ৪০ বছরের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। এ দৌড়ে ব্রিটেনও খুব পিছিয়ে নেই। জ্বালানি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় লন্ডনে বিক্ষোভ করেছে মানুষ।
মূল্যস্ফীতির হার ৫.৪ শতাংশ নিয়ে বছর শেষ করেছে ব্রিটেন। যদিও ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আর যে ১৯টি দেশে ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা হয়, সেসব দেশে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.১ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে ইউরো চালু হবার পর এটাই সর্বোচ্চ।
ইউরোপের দেশ ইতালিতে ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.২ শতাংশ। যদিও দেশটি আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল বলে ইউরোপের অন্য দেশের তুলনায় তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি।
জার্মানিতে এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতির হার অবশ্য কিছুটা কমে ৪.৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে সেটি ছিল ৫.৩ শতাংশ।
১৯৯০ সালে দুই জার্মানি একত্রিত হবার পর গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো দেশটির মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ ছাড়ায়। বলা হচ্ছে, এ বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেশিই থাকবে।
কেবল ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, এশিয়ার দেশগুলোতেও পরিস্থিতি তেমন কোনো সুখকর নয়।
জাপানে যেখানে ১৯৮০ দশকের মন্দার পর ধারাবাহিকভাবে জিনিসপত্রের দাম কমে আসছিলো বলে মূল্যস্ফীতি ছিল ঋণাত্মক, সেই দেশটিতেও গত ডিসেম্বরে ১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে।
পাকিস্তানে জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ শতাংশ। খাদ্য-পণ্যের দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার যারা তাদের আয়ের অর্ধেক খরচ করে খাবারের পেছনে, খরচ মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস উঠছে।
পাকিস্তান সরকার সম্প্রতি আইএমএফের কাছ থেকে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেইলআউট তহবিল পেতে ব্যয় সংকোচনের জন্য চেষ্টা করছে।
সেজন্য পেট্রলের ওপর কর, জ্বালানির ওপর শুল্ক ও উচ্চহারে কর বসিয়েছে। পাকিস্তানে জ্বালানির দাম এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে ঠিক এই মুহূর্তের হিসেব না পাওয়া গেলেও গত অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৭ শতাংশ।
কেন বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম?
মূল্যস্ফীতি বলতে সাধারণভাবে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়াকে বোঝানো হয়। এর মানে হচ্ছে অর্থনীতিতে যখন মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যায় কিন্তু পণ্য বা সেবার পরিমাণ একই থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। অর্থাৎ বেশি টাকা দিয়ে কম পণ্য বা সেবা কিনতে হয়।
মূলত মুদ্রাস্ফীতির ফলেই মূল্যস্ফীতি হয়, ইংরেজিতে যাকে বলে ইনফ্লেশন।
বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ট্রেন্ড ইতোমধ্যেই অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
ফোর্বসের মত সাময়িকীগুলো বলছে, ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকের পর এই প্রথম এত দ্রুত গতিতে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম, আর মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি সহসাই কমছে না। কিন্তু কেন বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম?
বিশ্ববাজারে এই মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণ সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের বিশ্লেষণ নেয়া হয়েছে।
তাদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে যেসব কারণ জানা যাচ্ছে:
১. চাহিদা-সরবারহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত
করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত সারা দুনিয়ায়াতে সবাইকে কমবেশি ধকল পোহাতে হয়েছে।
কিন্তু বছরের শেষ কয়েক মাসে কোভিডের প্রকোপ কমায় লকডাউন ও চলাচলে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়।
তখন নির্দিষ্ট পণ্য এবং সেবার অতিরিক্ত চাহিদা দেখা দেয়। লকডাউনে যে কেনাকাটা করতে পারেনি, যেখানে যেতে পারেনি হঠাৎ সেসব দিকে চাহিদা বাড়ে। রেস্তোরাঁয় এবং বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে ভিড় বাড়তে থাকে।
কিন্তু এই চাহিদার সাথে সরবরাহ ব্যবস্থা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না।
তার কারণ মহামারী পুরোপুরি চলে না যাওয়ায়, উৎপাদন এবং পণ্য পরিবহন মহামারী শুরুর পর্যায়ে এখনো যেতে পারেনি।
ফলে পণ্য ও সেবার চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালে বাইডেন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বড় ধরনের স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা করে, যার ফলে মানুষের পকেটে নগদ পয়সা বাড়ে কিন্তু সে তুলনায় বাজারে পণ্য কিংবা সেবা পর্যাপ্ত ছিল না।
২. পরিবহন
মহামারীর সময় দেশের ভেতরে ও বাইরে পণ্য পরিবহন ছিল বেশ কঠিন। সড়ক এবং আকাশপথে অনেক দেশেই যোগাযোগ উন্মুক্ত ছিল না।
অনেক দেশেই সংক্রমণের হারে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে সীমান্ত এবং বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
নৌপথে পরিবহনের ক্ষেত্রেও বড় সমস্যা ছিল।
বন্দরগুলোতে শ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকা বা না থাকার কারণে ঠিক সময়ে পণ্য খালাস করা যায়নি। এর ফলে খাদ্য-পণ্যের সরবারহে ঘাটতি তৈরি হয়।
একইসাথে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় এবং পরিবহন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। আর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে।
৩. শ্রমিক ঘাটতি
মহামারীর কারণে দেশে দেশে শ্রম বাজারে এক ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়, বিশেষ করে নারী শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কমে যায়।
মহামারিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে অনেক বেশি ছিল।
এছাড়া এ সময়ে নারী এবং বয়স্ক কর্মীরা অনেক বেশি হারে কর্মস্থল ছেড়েছেন, এবং অনেকেই পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হবার পরেও ফেরেননি।
বিশেষত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে এখনো বহু বয়স্ক কর্মী কাজে ফিরতে চান না। ফলে শ্রমিক স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি সহসা মিটবে এমন সম্ভাবনাও নেই।
৪. জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং এর সঙ্গে মিলিয়ে অন্যসব জিনিসের দামও বেড়ে যাওয়া।
ওইসিডিভুক্ত (তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোট) দেশগুলোতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জ্বালানির দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে।
খনিজ গ্যাসের মত যেসব জ্বালানি আছে সেগুলোর দাম বাড়লে তার সাথে অন্যান্য জিনিসেরও দাম বাড়ে, কারণ খনিজ জ্বালানি অন্য উৎপাদনের সাথে জড়িত।
এর বাইরে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বড় অর্থনীতির দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যে নানামুখী উত্তেজনা চলছে, তার ফলে জ্বালানি নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সেটিও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি কারণ।
এছাড়া অনেক তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ উত্তোলন বাড়াচ্ছে না ভবিষ্যতে আরো দাম বাড়বে এই আশায়। আর সরবরাহ কম থাকলে সবসময়ই দামবৃদ্ধি পায়।
৫. চীনের খাদ্যবাজারে অস্থিতিশীলতা
চীনের বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
নিজেদের চাহিদা মেটাতে দেশটি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, আবার আমদানিও করে। জ্বালানি ঘাটতির কারণে মহামারীতে চীনের বাজারেও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে।
এখন যদি কোনো অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, তাহলে তার প্রভাব পড়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও।
কতদিন চলবে এ পরিস্থিতি?
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সহসাই এই পরিস্থিতি কাটবে এমন সম্ভাবনা কম। তবে করোনা ভীতি কেটে গেলে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যাবে তখন ক্রমে এ পরিস্থিতি সহজ হয়ে আসবে।
সেসময় মানুষের চাহিদা কমবে, একই সঙ্গে মানুষের পকেটে বাড়তি তারল্য কমে যাবে, কারণ সরকারের দেয়া প্যাকেজ বারবার আসবে না, আর শ্রম বাজারে নিয়োগ আগের অবস্থায় যাবে।
এই সবকটি ব্যাপার স্বাভাবিকতায় ফিরতে ২০২২-এর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে-- এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
সূত্র : বিবিসি