২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাঙালির ইফতারে মুখরোচক খাবার, শুরুর গল্প

বাঙালির ইফতারে মুখরোচক খাবার, শুরুর গল্প -

রমজান মাসে বাংলাদেশের ইফতারে পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, চপ, ও গোশতের তৈরী কাবাবসহ বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার অনেকটা ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। সারা বছর এ ধরনের খাবার খুব গুরুত্ব না পেলেও বাংলাদেশে প্রায় সব বাড়িতেই পবিত্র রমজানে ইফতারের প্রধান আকর্ষণ এসব ভাজা-পোড়া খাবার। শুধু বাড়িতেই নয়, এ সময় খাবারের দোকানগুলোতেও এরকম মশলাদার ইফতার বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। যদিও এবার করোনার কারণে আগের মতো বিক্রি নেই। তবুও যে সব খাবারের দোকান খোলা দেখা যায় এর প্রতিটিতেই বরাবরের মতো প্রায় একই ধরনের ভাজা-পোড়া খাবার পরিবেশন হচ্ছে।

মুসলিম ধর্মীয় বিধিবিধানে ইফতারে এরকম মুখরোচক খাবারের রীতির উল্লেখ আছে বলে শোনা যায় না। তাহলে বাঙালির ইফতারের প্লেটে এরকম মুখরোচক ভাজা-পোড়া খাবার জায়গা করে নিলো কীভাবে?

ইসলামের ইতিহাসবিদরা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে এ উপমহাদেশে আসা ও শাসন করা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির মতো খাবারো এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় মিশে গেছে। এভাবেই ইফতারের খাবারের তালিকায় ছাপ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর খাবারের সংস্কৃতি।

ইফতারে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর খাবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুসরাত ফাতেমা বিবিসি বাংলা বলেছেন, ‘আমাদের ইফতারে যেসব খাবার খাওয়া হয়, এর বড় বেশিরভাগ এসেছে পার্সিয়ান বা মোঘল খাবারের তালিকা থেকে। এক সময় মোঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করতো। তারা যখন ঢাকা শাসন করেছে, তাদের খাদ্য তালিকা তখনকার ঢাকার লোকজন গ্রহণ করেছে। এরপর আস্তে আস্তে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’

ড. নুসরাত ফাতেমার ভাষায়, ‘আপনি যখন এমনিতে খাবেন, তখন হয়তো ভাত, মাছ, গোশত ইত্যাদি খাবেন। কিন্তু যখন ইফতারের প্রসঙ্গে যাবেন, তখন দেখবেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর খাবার মিশে গেছে।’

তিনি কয়েকটি খাবারের উদাহরণ দিয়েছেন। যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-

খেজুর : ইসলামের নবী ইফতারের সময় খেজুর খেতেন। ফলে ইফতারের সময় খেজুর খাওয়াকে সুন্নত মনে করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের থেকে এই রীতিটি সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বেই ইফতারের সময় খেজুর অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ বলে মনে করা হয়।

ইসলামিক সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম খাদেমুল হক বিবিসিকে বলেন, এটা তো রমজানের সাথে সম্পৃক্ত। হজরত মোহাম্মদ সা: ইফতারে খেজুর খেতেন। এ কারণে মনে করা হয় এটা ভালো অনুষঙ্গ। এজন্যই বাংলাদেশের মানুষ মনে করে ইফতারিতে সুন্নত খেজুর খাওয়া।

ছোলা : এটা আফগানদের প্রিয় খাবার। তাদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের ও বাংলাদেশের মুসলমানরা গ্রহণ করেছে। তারা কাবুলি চানা বা কাবুলি ছোলা খেয়ে থাকে। এখান থেকেই এটা খাওয়ার চল এসেছে। শবেবরাতের সময় যে বুটের হালুয়া তৈরি করা হয়, এর আসল নাম যেমন হাবশি হালুয়া, এটাও আফগানদের একটা খাবার। তবে ভারত বা বাংলাদেশে এসে সেটা আরো মশলা, পেঁয়াজ ইত্যাদি দিয়ে মুখরোচক করে রান্না করা হয়ে থাকে। এর সাথে মুড়ি খাওয়ার চলও এই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব উদ্ভাবন।

কাবাব, হালিম ও বিরিয়ানি : মোঘল খাবারের মধ্যে পারসিক খাবারের প্রভাবটা অনেক বেশি ছিল। তারাই ইফতারে বিরিয়ানি ও কাবারের মতো খাবার খেতো। এটা দেখে এই অঞ্চলের বনেদি মানুষজনও খেতে শুরু করে, বলছেন ড. নুসরাত ফাতেমা।

এখনো ইরান, আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে ইফতারের সময় কাবাব সহযোগে বিরিয়ানি বা পোলাও খাওয়ার চল রয়েছে।

পেঁয়াজু, বেগুনি ও চপ : এটা উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন এলাকার খাবারে ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানান ড. ফাতেমা। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলে ইসলাম ছড়ানোর সময় অ্যারাবিক প্রভাব ছিল। একইসাথে পার্সিয়ান প্রভাবও ছিল। পরবর্তীকালে তা একপ্রকার ভারতীয়করণও হয়। ভারতে এসে মূলত উত্তর ভারত থেকে ইফতারের সময় মুখরোচক খাবারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন রকমের ভাজা-পোড়া খাওয়ার চল যোগ হয়েছে। তখন পেঁয়াজু, বেগুনি ও বিভিন্ন ধরনের চপ খাওয়ার চল যুক্ত হয়। এটাই পরবর্তীকালে আমরাও গ্রহণ করেছি।

শরবত : ইফতারে শরবত খাওয়ার রীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতে রয়েছে। পানির পিপাসা থেকে স্বাদ, মিষ্টি ও সুগন্ধি শরবত খাওয়ার চল চালু হয়েছে বলে মনে করেন ইসলামী ইতিহাসবিদরা।

বাংলাদেশে কি বরাবরই তেলেভাজা মুখরোচক খাবার দিয়ে ইফতার করা হতো?
ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এখন যেভাবে ইফতারে মুখরোচক খাবার, গোশত, জিলাপি বা ভাজা-পোড়া খাওয়া হয়ে থাকে এটা কয়েক শ’ বছরের পুরনো।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেছেন, বাঙালি সংস্কৃতিতে ইসলামে ইফতারের সময় কয়েক শ’ বছর আগের বর্ণনাতেও এরকম ভাজা-পোড়া খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় না। সুতরাং বলা যায়, কয়েক শ’ বছর আগেও এগুলো ছিল না। তার মতে, ‘কোনো এক সময় মোঘলদের কাছ থেকে ঢাকার লোকজন এরকম বিরিয়ানি, কাবাব, ভাজা-পোড়া খাওয়া গ্রহণ করে। তাদের কাছ থেকে এটা আস্তে আস্তে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা যায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘উনিশ শতকের দিক থেকে এরকম খাবার এ অঞ্চলের মানুষ খেতে শুরু করেছে বলে ধারণা করা হয়। এর আগে বইপত্রে এরকম রকমারি খাবারের বর্ণনা পাওয়া যায় না। বরং ওই সময় মানুষ ইফতারে ভাত খেতো বলেই তথ্য পাওয়া যায়।’

অধ্যাপক ড. নুসরাত ফাতেমাও বলেছেন, ভারতবর্ষে আরব, পার্সিয়ান, আফগান ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির শাসকদের কারণে তাদের খাবার আর সাধারণ মানুষের মধ্যে খাবারের পার্থক্য ছিল। তবে পরবর্তীকালে আস্তে আস্তে তাদের এসব খাবার এখানকার স্থানীয় মানুষ গ্রহণ করতে শুরু করে। এভাবেই স্থানীয় খাবারের সাথে তাদের খাবারের রীতি মিশে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মো: ইউসুফ বলেছেন, ‘ছোলা, পেঁয়াজু, কাবাব ইত্যাদি আমরা সারা বছরই কম-বেশি হালকা নাস্তা হিসেবে খেয়ে থাকি। কিন্তু রমজানের সময় এটা মজাদার বা মুখরোচক খাবার হিসেবে যুক্ত হয়ে গেছে। সারা দিন অভুক্ত থেকে সন্ধ্যায় এরকম মজাদার খাবার খেতে ভালো লাগে ‘

এরসাথে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের কোনো সম্পর্ক নেই বলেও জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহিন বলেন, যদিও বিশেষ কোনো কারণ বা পুষ্টিমাণের ব্যাপার নেই। তবে এ অঞ্চলের মানুষ একটু মুখরোচক, তেলেভাজা খাবার খেতে পছন্দ করে। এ কারণে ইফতারের মধ্যেই তা যুক্ত হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশে এখনো বিভিন্ন এলাকায় ইফতারের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। অনেক এলাকায় পেঁয়াজু বা বেগুনির বদলে সন্ধ্যায় খেজুর ও শরবত খেয়ে ইফতার করার পরপরই ভাত বা খিচুড়ি খাওয়ারও চল রয়েছে।

ইসলামে ইফতারে খাবার সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মো: ইউসুফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ইফতারে ইসলামের নবী খেজুর খেতেন, মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতেন। বাকি যে খাবারগুলো আছে, এগুলো বিভিন্ন দেশ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা যে সমস্ত খাবার পছন্দ করে, এগুলো খেয়ে থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ইফতারে বাংলাদেশী বা পাকিস্তানি লোকজন বুট, মুড়ি, ছোলা খেয়ে থাকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কিন্তু এগুলো খায় না। তারা বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট বা ফ্রাই খায়, সাথে খেজুর খায়। ইফতারে সুন্নত বলতে একটা মিষ্টি খাবার, খুরমা বা খেজুর বুঝি। বাকি খাবারের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। যার যার রুচি অনুযায়ী, সংস্কৃতি অনুযায়ী এ খাবার গ্রহণ করা হয়।

ইফতারে কী ধরনের খাবার খাওয়া ভালো?
ইফতারে মুখরোচক হলেও তেলেভাজা খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ততোটা ভালো নয় বলেই মনে করেন পুষ্টিবিদরা। পুষ্টিবিদরা মনে করেন, ইফতারের খাদ্য তালিকায় এমন খাবার থাকা উচিত, যা সহজে শরীরে পুষ্টি, পানি ও শক্তির যোগান দেবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘তেলেভাজা খাবার সবার শরীরের জন্য ঠিক নয়। যেগুলো ডিপ ফ্রাই হয়, অনেক বেশি ভাজা-পোড়া এগুলো অনেকের জন্য অ্যাসিডিটি ও পেটের সমস্যা তৈরি করতে পারে।’

অনেক দিন ধরেই পুষ্টিবিদরা এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বলে তিনি জানান। তার মতে, ‘বিশেষ করে বাইরে থেকে যেসব খাবার কিনে এনে রমজানের সময় খাওয়া হয় এর অনেক খাবার খোলা অবস্থায় বিক্রি করা হয়। তৈরির সময়ও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। ফলে এসব খাবার শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

তার পরামর্শ হচ্ছে, ছোলাটা শরীরের জন্য খারাপ নয়। একইসাথে খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকা ও মিষ্টিজাতীয় খাবার রাখা উচিত। তবে প্রতিদিন তেলেভাজা খাবার না খেয়ে চিড়া, ফলমূলজাতীয় খাবার খাওয়া শরীরের জন্য ভালো।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement