সালতামামি ২০২০ : করোনা, যুদ্ধ, বিক্ষোভ ও বিস্ফোরণ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫১, আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫২
শেষ হচ্ছে ২০২০ সাল ঘটনাবহুল একটি বছর। যে বছর জুড়ে ছিল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির খবর। যা সারা পৃথিবীকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। যন্ত্রণার কারণ হয়েছে অনেক মানুষের জন্য।
চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। হুবেই প্রদেশে উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারের সাথে প্রথম সংক্রমণগুলোর সম্পর্ক আছে। কিন্তু চীনা গবেষকদের এক জরিপ, যা ল্যান্সেট চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় এ বছরের গোড়ার দিকে, তাতে বলা হয় করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেশটিতে প্রথম পাওয়া যায় ২০১৯-এর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে।
নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে বিভিন্ন নামে ব্যাখ্যা করা হলেও ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, কোভিড-১৯।
প্রথম দিকে নতুন এই রোগটিকে বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন : ‘চায়না ভাইরাস’, ‘করোনাভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’ ও ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি। পরে ২০২০ সালের ১১ মার্চ কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবকে বিশ্ব মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস আক্রমণকারী এই ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের জীবন। অনেক মানুষ শিকার হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতার। ২১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত জন্স হপকিন্সের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীব্যাপী এই ভাইরাসে সংক্রমিতের সংখ্যা সাত কোটি ৬৮ লাখ আর মৃতের সংখ্যা ১৭ লাখ।
এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ। বলা হচ্ছে, ১৯৩০ দশকে যে বিশ্ব মহামন্দা পরিস্থিতি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তার পর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধ্স নেমেছে। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে লেগে যাবে অনেক বছর।
এই রোগের উৎস কোথায়, কখন চীন প্রথম এই রোগ সম্পর্কে জেনেছিল, এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে কতটা সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, এই ভাইরাস মানুষের তৈরি নাকি গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বাইরে চলে এসেছে, এসব নিয়ে সারা বছর ধরে চলেছে নানা জল্পনা, তথ্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়া। এসব প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে করোনার উৎস খুঁজে বের করতে ১০ জন বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক দল আগামী মাসে (জানুয়ারিতে) চীনের উহান শহর সফর করবেন।
তদন্তকারী দলের একজন জীববিজ্ঞানী সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারো উপর দোষ চাপানোর উদ্দেশে এই তদন্ত পরিচালনা করছে না, বরং ভবিষ্যত সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করাই তাদের অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, চীনের উহানে গত বছরের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর এ পর্যন্ত এটি অন্তত ১৭ বার মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। সম্প্রতি ভাইরাসটির নতুন এবং আরো বেশি সংক্রামক আরেকটি জাত আত্মপ্রকাশ করার পর নতুন করে দেশে দেশে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
বৈরুত বিস্ফোরণ
লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে ৪ অগাস্ট রাসায়নিক পদার্থের এক গুদামে বিস্ফোরণ ছিল এ শতাব্দীর ভয়াবহতম ‘অ-পারমাণবিক’ বিস্ফোরণ।
বৈরুতের বন্দর এলাকায় অনেক বছর ধরে মজুত রাখা প্রায় দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণে নিহত হন দুই শতাধিক মানুষ, আহত হন ছয় হাজারেরও বেশি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় বিধ্বংসী বিস্ফোরণের ঠিক আগে বন্দরে বিশাল এক শস্যের গুদামে আগুন লাগে। তার ৩০ সেকেন্ড পরেই এক বিশাল ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে প্রথম সৃষ্টি হয় বিশাল আগুনের গোলা, তার পর বাতাসের ঝাপটায় তৈরি হয় ব্যাঙের ছাতার মতো আকারের পানি ও বাষ্পের সাদা মেঘ। তার মুহূর্ত পরই পাক খেয়ে উঠতে থাকে লাল রঙের ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ওই সাথে শহরের সর্বত্র বিস্ফোরণের ভয়ানক কান ফাটানো তীব্র শব্দ। পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র চার সেকেন্ডের মধ্যে।
যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল বলে, ওই বিস্ফোরণের আনুমানিক শক্তি ছিল কমপক্ষে ৫০০ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমান। টিএনটি হচ্ছে যুদ্ধে ব্যবহৃত বোমায় যে বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয় - তার সংক্ষিপ্ত নাম।
গবেষক দলের ড: স্যাম রিগবি বিবিসিকে বলেন, “ওই বিস্ফোরণ ছিল যুদ্ধে ব্যবহৃত ‘কনভেনশনাল’ বা প্রচলিত অস্ত্রের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বড় তার চাইতেও ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী।”
জর্জ ফ্লয়েড হত্যা ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন
যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশ হেফাজেতে এক কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর জের ধরে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন। পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় মারা যান ৪৬ বছর বয়সী আফ্রিকান আমেরিকান নাগরিক ফ্লয়েড।
অনলাইনে ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রায় আট মিনিট ধরে ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু গেড়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছেন ৪৪ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। জর্জ ফ্লয়েড দম নিতে না পেরে হাঁপাচ্ছেন, আর কাতর কণ্ঠে বারবার অনুনয় করছেন, ‘প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ’। ভিডিওটি করেন পথচারী ১৭ বছরের তরুণী ডারনেলা ফ্রেজিয়ার।
ওই হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন। তাকে আদালতে নেয়ার পর এক মিলিয়ন ডলারের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। আগামী বছর মার্চে বিচারের শুনানি হবার কথা। ওই সময়ে সেখানে উপস্থিত থাকা আরো তিনজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়।
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। করোনাভাইরাস আতঙ্ক উপেক্ষা করে মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভে পথে নামে। বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে জারি করা হয় কারফিউ। যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষিত সামরিক বাহিনী, ন্যাশনাল গার্ডের সৈন্য মোতায়েনের ঘটনাও ঘটে।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর পৃথিবীর নানা প্রান্তে পৌঁছায় এই প্রতিবাদের ঢেউ। জন্ম নেয় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন - ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার।
সমাজ ব্যবস্থা থেকে বর্ণবাদসহ সব ধরণের বৈষম্যের অবসানের দাবি তুলতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ। এর অনুষঙ্গ হিসেবে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক ঐতিহাসিক নেতা বা বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করে কিংবা সেগুলো উপড়ে ফেলে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন
সারা বছর ধরে বিশ্বের নজর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৪ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০-সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে ছিল নজিরবিহীন সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভাজন, তিক্ততা ও নোংরামি।
ফলাফল ঘোষণার পর্বও ছিল চরম নাটকীয়। ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যখন দাবি করেন তিনি জয়ের পথে রয়েছেন, তখন রিপাবলিকান ট্রাম্প ভোট জালিয়াতি এবং ব্যালট চুরির অভিযোগ এনে দাবি করেন নির্বাচনে তিনিই জয়ী হয়েছেন।
প্রচারণার সময়ই ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, নির্বাচনী ফলের ব্যবধান যদি খুব কম হয়, তিনি তার বিজয় ছিনিয়ে নেবার লক্ষ্যে ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনবেন। কয়েক লাখ বৈধ ব্যালট গণনা বাকি থাকতেই তিনি নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। তার ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ জো বাইডেনও বলেন ‘প্রতিটি ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত’ এই নির্বাচন শেষ হবে না। তিনিও জোর দিয়ে বলেন ‘ডেমোক্র্যাটরা জয়ের পথে রয়েছে।’
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে জো বাইডেনের পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয় ১৫ ডিসেম্বর। বাইডেন পান ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পান ২৩২টি।
নির্বাচনের পর থেকেই ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, ফল নিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন, আইনি পদক্ষেপসহ বিভিন্নভাবে ফল পাল্টানোর চেষ্টা করেন মামলা করার মাধ্যমে। তবে ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পর এখনো চুপ করে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তিনি এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু তার মামলাগুলো একের পর এক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
ট্রাম্প শিবির বলছে, তাদের আইনি লড়াই চলতে থাকবে, এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন - যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোনো আপিল শোনা হবে কিনা এবং তা নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে পারবে কিনা - তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ভোটের ফল এখন ওয়াশিংটন ডিসিতে পাঠানো হবে এবং কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে আগামী ৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক গণনা হবে। এটাই আগামী ২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের শপথ নেয়ার পথ তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন একজন নারী। শুধু নারী হিসেবেই নয় কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভুত ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েও ইতিহাস তৈরি করেছেন।
ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে নতুন মোড়
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৩ অগাস্ট ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান এই ঘোষণাকে ব্যাখ্যা করেন ‘মধ্যপ্রাচ্যের একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প’।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন। পুরো আলোচনাটি চলেছিল এতটাই গোপনে যে, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত নাকি এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হিব্রুতে টুইট করেন, ‘এক ঐতিহাসিক দিন।’
এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জানায়, ‘এই ঐতিহাসিক অগ্রগতি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির অগ্রযাত্রায় সাহায্য করবে’ বলে তারা আশা করেন। তারা জানায়, দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরাইল পশ্চিম তীরের বিশাল ফিলিস্তিনি এলাকা ইসরাইলের অংশ করে নেয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখবে।
এর এক মাস পরেই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দেয় বাহরাইনও। ইসরাইলের জন্য এই দুটি আরব রাষ্ট্রের সাথে হাত মেলানো ছিল সত্যিকার অর্থেই এক বিরাট অর্জন। তবে, গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ইসরাইলি দখলদারিত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পুরো আরব বিশ্বের যে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন ছিল, এই ঘোষণা আসে তার প্রতি একটা বড় আঘাত হিসেবে।
ফিলিস্তিনিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে মন্তব্য করেন। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর নিন্দা করে বলেন, ‘এটি জেরুসালেম, আল-আকসা ও ফিলিস্তিনিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।’
এই দুই আরব রাষ্ট্রের ঘোষণার পর সৌদি আরবও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে ছিল ব্যাপক জল্পনা।
১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর বাহরাইন ও আরব আমিরাত তৃতীয় ও চতুর্থ উপসাগরীয় দেশ হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিল। এর আগে মিসর ১৯৭৯ সালে এবং জর্ডান ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
যুদ্ধের দামামা
নাগোর্নো-কারাবাখ পূর্ব ইউরোপে দক্ষিণ ককেশাসের বিরোধপূর্ণ এলাকাটিকে কেন্দ্র করে ২৭ সেপ্টেম্বর আবার যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে। এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এর আগেও সংঘর্ষ হয়েছে। সমঝোতার মাধ্যমে ছয় বছর ধরে চলা যুদ্ধ ১৯৯৪ সালে থেমে গেলেও তাদের মধ্যে কখনো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।
আন্তর্জাতিকভাবে এই এলাকাটি আজারবাইজানের অংশ বলে স্বীকৃত হলেও, আর্মেনিয়ার সরকারের সমর্থনে জাতিগত আর্মেনিয়রা এটি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দুটি দেশই এলাকাটিকে তাদের নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় নভেম্বরে একটা শান্তি চুক্তি হলেও তা কার্যকর হয়নি। ছয় সপ্তাহের বেশি চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দু’পক্ষের পাঁচ হাজারের বেশি সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে।
ইথিওপিয়া- দেশটির সরকারি বাহিনীর সাথে উত্তরে টিগ্রে’র ক্ষমতাসীন দল টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) মধ্যে তীব্র লড়াই শুরু হয় নভেম্বর মাসে।
ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যাবি আহমেদ টিগ্রের আঞ্চলিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, টিগ্রেতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সৈন্য ঘাঁটিতে টিপিএলএফের হামলার জবাবে তিনি সামরিক আগ্রাসনের নির্দেশ দিয়েছেন।
টিপিএলএফ-এর নেতাদের সাথে অ্যাবি আহমেদের তিক্ত সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে কয়েক শ’ মানুষ মারা গেছে এবং কয়েক হাজার মানুষ ঘড়ছাড়া হয়েছেন। সরকারি বাহিনী টিগ্রের ওপর স্থল ও বিমান আক্রমণ চালিয়েছে।
লিবিয়া- এই দেশটিতেও দীর্ঘ দিন ধরে চলা অশান্তির আগুনে ভাঁটা পড়েনি। বর্তমানে লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘের সমর্থন পুষ্ট সরকার, বিদ্রোহী নেতা জেনারেল খালিফা হাফতারের বিদ্রোহী বাহিনীর সাথে লড়ছে। লিবিয়ার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বড় অংশ এই মুহূর্তে খালিফা হাফতারের বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
লিবিয়া নিয়ে নেটো জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং লিবিয়ার বিবদমান দু’পক্ষের পেছনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলেছে।
জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে সহায়তা করছে রাশিয়া, মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। অন্যদিকে ত্রিপলি সরকারের পেছনে রয়েছে তুরস্ক ও তার মিত্র দেশ কাতার। লিবিয়ার যুদ্ধেও প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ, বাস্তুহারা হয়েছে কয়েক লাখ।
দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ এখনো চলছে এবং লিবিয়া বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের দূত নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ জানিয়েছেন, দু’পক্ষ একটা নির্বাচনের রূপরেখা নিয়ে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে।
হংকং- হংকংয়ে গণতন্ত্রকামীদের অব্যাহত চীন বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে কর্তৃপক্ষ নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন আনার প্রস্তাব করলে হংকংয়ে এর বিরোধিতা করে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলে প্রতিবাদকারীদের। গ্রেফতার হয় শত শত মানুষ। এরপর ৩০ জুন চীন দেশদ্রোহিতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও নাশকতা নিষিদ্ধ করে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাশ করে। সমালোচকরা বলছেন, হংকংয়ের সংক্ষিপ্ত সংবিধানে দেশটিকে যে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে এই আইন তা খর্ব করবে।
থাইল্যান্ড- জুলাই মাস থেকে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র আর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানোর দাবিতে। থাইল্যান্ডের রাজার অসীম ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানাচ্ছে তারা, রাজার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয়েরও সীমা বেঁধে দিতে চায় তারা। থাইল্যান্ডের আধুনিক ইতিহাসে রাজাকে এরকম প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার উদাহারণ আর নেই। বিক্ষোভ দমনে সরকার সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, জারি করেছে জরুরি অবস্থা। তরুণ প্রজন্ম যেভাবে রাজতন্ত্র এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে তাতে এটি এক দীর্ঘ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের শুরু বলেই অনেকে মনে করছে।
বেলারুশ- বেলারুশে ৯ অগাস্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখান করে বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। ২৬ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর পদত্যাগের দাবিতে এই বিক্ষোভে যেভাবে দেশটির মানুষ অংশ নেয় তা ছিল অভূতপূর্ব। অনেক নগরী, শহর ও গ্রামে পর্যন্ত এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ পথে নামে। তারা নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী স্ভেৎলানা তিখানোভস্কায়াকেই বিজয়ী ঘোষণার দাবি জানায়। বিক্ষোভে আটক হয় হাজার হাজার মানুষ। বেলারুশে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশি নির্মমতার ব্যাপক অভিযোগ ওঠে। সাত ঘণ্টা আটক অবস্থায় থাকার পর মুক্তি পেয়েই মিস তিখানোভস্কায়া পালিয়ে যান লিথুয়ানিয়ায়। নভেম্বরের শেষে লুকাশেঙ্কো প্রথমবারের মতো ইঙ্গিত দেন তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। তবে কবে তা তিনি বলেননি।
লেবানন- লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য সরকারের অবহেলাকে দায়ী করে সরকারের বিচারের দাবিতে পথে নামে বৈরুতবাসী। বিস্ফোরণ পরবর্তী সরকার বিরোধী এই বিক্ষোভ ছিল নজিরবিহীন। নিহতের সংখ্যা বাড়ার পটভূমিতে গণ অসেন্তোষের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব। ইতোমধ্যেই দেশের রুগ্ন অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, দুর্নীতির অবসান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে দেশে বিক্ষোভ চলমান ছিল। ধর্মের ভিত্তিতে ক্ষমতার ভাগাভাগির ব্যবস্থারও পরিবর্তন চাইছিল দেশের মানুষ।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং দেশের অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণীর বলি হিসেবে তারা ভোগান্তি পোহাচ্ছে। জিডিপি ও বৈদেশিক ঋণের অনুপাতের হিসাবে লেবানন এই মূহূর্তে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণগ্রস্ত দেশ।
করোনার টিকা- আশার আলো
বছরের শুরুতে অচেনা এক জীবাণু সারা বিশ্বে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল, তার দাপট চলেছে সারা বছর ধরে। সংক্রমণ ঠেকাতে সারা বছর ধরে হিমশিম খেয়েছে দেশগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, একমাত্র একটা কার্যকর টিকাই পারে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে।
কিন্তু নভেম্বরের ৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানির বায়োনটেক যৌথভাবে টিকা উদ্ভাবনে তাদের সাফল্য ঘোষণা করে জানায়, তাদের টিকার ক্লিনিকাল ট্রায়ালে প্রমাণ হয়েছে করোনার আক্রমণ থেকে লোকজনকে রক্ষা করতে তাদের টিকা ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকর। তারা বলে, ‘বিজ্ঞান ও মানবতার জন্য এটি অনেক বড় একটি দিন।’
ছয়টি দেশে ৪৩ হাজার ৫০০ জনের শরীরে এই টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে এতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু দেখা যায়নি বলে তারা জানায়।
ডিসেম্বরের গোড়ায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজার/বায়োনটেকের করোনাভাইরাস টিকার অনুমোদন দেয় ব্রিটেন এবং শুরু হয় তাদের টিকাদান কার্যক্রম।
টিকা তৈরির যেসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়, সেখানে মাত্র ১০ মাসে এই টিকা আবিস্কারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটা নজিরবিহীন অর্জন।
যুক্তরাষ্ট্রেও ডিসেম্বরে ফাইজার/বায়োনটেক এবং দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠান মডার্নার ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়ে ওই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে যে টিকাটির দিকে বিশ্বের অনেক দেশ তাকিয়ে আছে তা হলো ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রা জেনেকার ভ্যাকসিন। তাদের টিকাটি আরো সহজলভ্য, দামে কম এবং বিতরণ ও মজুদ সহজ। এই টিকাটি খুব শিগগিরই অনুমোদিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া রাশিয়া গত অগাস্ট মাসে স্থানীয়ভাবে ব্যবহারের জন্য স্পুটনিক ভি নামের তাদের টিকাকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং এখন তা ব্যবহারও শুরু হয়েছে। এই টিকা ৯২% নিরাপদ বলে বলা হচ্ছে। এবং তাদের ট্রায়ালের ফলাফলও অল্প দিনের মধ্যেই প্রকাশ করার কথা।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরো অনেক কোম্পানিই এখন করোনার টিকা তৈরির কাজ করছে এবং তাদের ট্রায়াল বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। মানুষ আশা করছে সফল ও কার্যকর টিকাই একমাত্র এই ভয়াবহ রোগের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে মানুষকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারবে।
সূত্র : বিবিসি