সাপুড়েদের সময় কাটে চায়ের আড্ডা আর তুরুপের তাসে
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৭:১৮
সাভার নামাবাজারের উত্তর দিকে বংশী নদীর পূর্বপাড়ে বেদেদের বসবাস। বাপ-দাদার আদিম পেশা হিসেবে সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো ও ঝাড়ফুঁকের সাথে জড়িত এখানকার কয়েক হাজার পরিবার। সারা বছরই এসব পরিবারের পুরুষ ও মহিলা সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তাদের এই আদিম পেশার মাধ্যমে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। তবে সাপ ধরতে মন্ত্রই সব নয়। মন্ত্রের সাথে লাগে কৌশলও। অনেকসময় মন্ত্র আর কৌশলÑ কোনোটিই সাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারে না সাপুড়েকে। দীর্ঘ ৭২ বছরের সাপ ধরার নানা কৌশল আর অভিজ্ঞতার কথা নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন সাভারের বেদেপল্লীর সাপুড়ে সর্দার তোরাব মিয়া।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তোরাব মিয়া রপ্ত করেছিলেন সাপ ধরার নানা মন্ত্র আর কৌশল। ওস্তাদ বা গুরুর কাছ থেকে নিজের সিনায় ধারণ করেছেন ঝাড়ফুঁকের কিছু কালাম (!)। এসব মন্ত্র, কালাম আর কৌশলের আশ্রয় নিয়েই সংসারের জন্য আয় করেছেন। খোরাক জুটিয়েছেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যা মিলে সাতজনের সংসারের।
বাবা-মায়ের হাত ধরে দীর্ঘ ৫০ বছর আগে তোরাব মিয়া ভারতের আসাম রাজ্যের কামরূপ কামাখ্যা অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের সাভারের বংশী নদীর পূর্ব পাড়ে এসে বসতি গড়েন। বাংলাদেশের নানা প্রান্তে তো বটেই, নিয়মিতভাবে বছরের বেশ কিছু সময় ভারতে গিয়েও সাপ ধরা ও কবিরাজি চিকিৎসায় সময় কাটিয়েছেন তিনি। তোরাব মিয়াকে সাপ ধরার কৌশল শিখিয়েছেন ভারতের কামরূপ কামাখ্যা অঞ্চলের সর্পরাজ ওস্তাদ টিপু সর্দার। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। তোরাব মিয়ার মতো এমন শত শত শিষ্য ছিল টিপু সর্দারের। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে টিপু সর্দারের শিষ্যরা নিজেরাই এখন ওস্তাদ হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যরা এখনো দিব্যি এই ব্যবসাও করছেন।
তোরাব মিয়ার বয়স এখন ৮৫ বছর। বয়সের ভারে একেবারেই তিনি ন্যুব্জ। শুধু এই তোরাব সর্দারই নন, তার মতো এমন অনেক দাপুটে সাপুড়ে সর্দারদের এখন অলস সময় কাটে। কাজের সন্ধানে বাইরে যেতে পারেন না। দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় কাটে তাদের মহল্লার চায়ের দোকানে আর সমবয়সীদের সাথে খোশগল্পের আড্ডায়। কখনো কখনো অলস সময় পার করতে মুরুব্বিরা একসাথে চৌকোনা হয়ে বসে মন দেন কলব্রিজের তুরুপের তাসে।
নিজের দুই হাতের আঙুল আর তালু দেখিয়ে তোরাব মিয়া বলেন, হাতের দশটি আঙুলের সব ক’টিতেই বিষাক্ত সাপের অসংখ্য ছোবল আছে। হাতের আঙুলের চামড়া ঢিলা হয়ে ঝুলে গেছে। ক্ষতস্থানগুলো কয়েক বছর আগেও স্পষ্ট দেখা যেত; কিন্তু এখন ছোবলের ওই দাগ বোঝাই যায় না। সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে যতগুলো ছোবল তিনি খেয়েছেন, তার চেয়ে কয়েক শ’ গুণ বেশি ছোবল খেয়েছেন সাপ ধরতে গিয়ে। তবে অসংখ্যবার সাপের ছোবল খেলেও নিজের চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়েছেন তিনি। অন্য কোনো ডাক্তার বা কবিরাজের সাহায্য তাকে নিতে হয়নি কোনোকালেই।
তোরাব মিয়া আরো জানালেন, দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পর আমাদের বেদেপল্লীতে রাজধানী ঢাকা থেকে চারজন লোক আসেন জীবন্ত সাপের দাঁত কিনতে। কোনো সাপুড়ে সাপের দাঁত দিতে রাজি হননি; কিন্তু চড়া দামের লোভে আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জীবন্ত বিষধর সাপের দাঁত তুলতে গিয়ে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে ছোবল খাই। এভাবেই বিষাক্ত সাপের বিষে কাতরও হয়েছি বহুবার। গৃহস্থের বাসাবাড়ি থেকে সাপ ধরার চুক্তিতে গিয়ে সেখানেও সাপের ছোবল খেয়েছি অনেকবার।
তোরাব মিয়ার তিন ছেলে দুই মেয়ে। স্ত্রী এখন অসুস্থ। আগে এই স্ত্রীকে নিয়েই দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সাপ ধরেছেন, খেলা দেখিয়েছেন। নানা রোগের চিকিৎসাতেও স্বামী-স্ত্রী দু’জনই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সাপে কাটা, হাতে ও পায়ের গিঁটে ব্যথার জন্য শিঙ্গা লাগানো, সংসারে অশান্তির জন্য তাবিজকবজও বিক্রি করেছেন দেদার। এ ছাড়া স্ত্রীলোকের বন্ধ্যত্ব, প্যারালাইসিস, মৃগী রোগ, শ্বেতী রোগের চিকিৎসার জন্যও তার খ্যাতি ছিল দেশের সবখানে। টাকাও কামিয়েছেন দুই হাতে। তোরাব মিয়ার ভাষায়, বেদেদের এই চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে সর্বপ্রাচীন। এই চিকিৎসায় টাকা খরচ করলে কেউ কোনো দিন ঠকবে না (!)।
সাভারের বেদেপল্লীর লোকজনের সাথে কথা বলে আরো জানা গেল, কর্ম বা কাজে থাকা অবস্থায় বেদেদের ওস্তাদ বা বয়স্ক বেদেদের বলা হয় সর্দার। আর যখন তিনি অবসরে চলে যান বা কাজ থেকে দূরে থাকেন তখন সেই বয়স্ক পুরুষ বেদেদের বলা হয় মাতুব্বর। তোবার মিয়াকে এখন সবাই মাতুব্বর বলেই ডাকেন। তোরাব মিয়ার মতো তার ছোট ভাই কালু সর্দারও এখন সাভারের এই ছোট অমরপুরের একজন খ্যাতিমান মাতুব্বর। কর্মজীবনে এই কালু সর্দার ছিলেন দেশকাঁপানো বেদে সর্দার। কালু সর্দার নামে সবাই একনামে চিনত তাকে। তিনিসহ সব মাতুব্বরের ঠিকানাই এখন বাড়ির পাশের চায়ের দোকান অথবা রাস্তার পাশে বাঁশের মাচার ওপর কলব্রিজের তুরুপের তাসের চৌকোনা মজমা।