বাংলাদেশে জাপানি বিমান ছিনতাই, তারপর যা হল
- বিবিসি
- ০৫ অক্টোবর ২০১৮, ২১:১১
প্রায় দেড় সপ্তাহের শ্বাসরুদ্ধকর এক নাটকীয়তার পর ঢাকায় নিয়ে আসা জাপানি এক বিমান ছিনতাই-এর ঘটনার অবসান হয়েছিল ৫ই অক্টোবর। ছিনতাইকারীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত সকল জিম্মিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে এই জিম্মি নাটক শুরু হয়েছিল মুম্বাই-এর আকাশে কিন্তু পরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েকদিন, তারপর কুয়েত, সিরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত এই নাটকের যবনিকাপাত ঘটে আলজেরিয়ায়।
জাপান এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী ওই বিমানটিকে জাপানিজ রেড আর্মির জঙ্গিরা অপহরণ করার পর এটিকে ঢাকার তেজগাঁওয়ে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করাতে বাধ্য করেছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তখন উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
যাত্রীবাহী ওই বিমানটি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ভারতের মুম্বাই হয়ে ব্যাংকক যাচ্ছিল। জাপান এয়ারলাইন্স বা জালের এই ফ্লাইট ৪৭২ এর ডিসি ৮ বিমানটিতে তখন ১৪ জন ক্রুসহ ১৩৭ জন যাত্রী ছিলেন। অর্থাৎ মোট আরোহী ১৫১ জন।
ওই একই সময়ে বাংলাদেশের বিমানবাহিনীতে ঘটেছিল এক অভ্যুত্থানের ঘটনা যার উত্তাপ গিয়ে লেগেছিল বিমান ছিনতাই-এর নাটকীয়তার ওপরেও। বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এই জিম্মি নাটকের অবসানের সাথে জড়িত ছিলেন।
সেসময় ছিনতাইকারীদের সাথে দরকষাকষি করতে ঢাকায় এসেছিল জাপানের একটি প্রতিনিধি দল। তার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ছিনতাইকারীদের সাথে দরকষাকষির দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ।
জাপানি মন্ত্রী ইশিই এই পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটি সম্প্রতি বাংলায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম: 'ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭: জাপানি মন্ত্রীর স্মৃতিকথা।'
ডেটলাইন ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
ঘটনাটি ছিল ১৯৭৭ সালের। ২৮শে সেপ্টেম্বর বিমানটি মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে উড়ান শুরু করার ১২ মিনিট পরেই এটিকে ছিনতাই করা হয়।
ইশিই তার বইয়ে লিখেছেন, বিমানটি রওনা হওয়ার পর সিট-বেল্ট বেঁধে রাখার সঙ্কেতটি নিভে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটে। একজন যাত্রী তাকে জানান যে ইকোনমি ক্লাস থেকে হঠাৎ পাঁচজন তরুণ তাদের আসন ছেড়ে চিৎকার করতে করতে ককপিটের দিকে এগিয়ে যায়। যাত্রীদের দিকে তারা পিস্তল উঁচিয়ে ধরে। এবং এক পর্যায়ে ককপিটের দরজা খুলে তারা ভেতরে ঢুকে পড়ে।
বিমানের পাইলট একবার বোম্বে বিমানবন্দরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ছিনতাইকারীরা সেটি করতে দেয়নি। তাদের হুঁশিয়ারির মুখে ক্যাপ্টেন তাকাহাশি বাধ্য হয়ে বিমানটিকে আবারও পূর্বমুখী করে আরো উঁচুতে নিয়ে যান।
ওই যাত্রী জানান যে তখন বিমানের ভেতরে যাত্রীদের আসন বদল করা হয়। নারী ও বয়স্ক যাত্রীদের বসানো হয় করিডরের পাশের আসনগুলোতে। আর পুরুষদের নিয়ে বসানো হয় জানালার পাশে।
ওই যাত্রীকে উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, তারা (ছিনতাইকারীরা) ফ্লাইট ম্যাপ দেখতে দেখতে নির্দেশ দিতে থাকে কত উচ্চতায় কোন রুট দিয়ে যেতে হবে। বিমানটির অবস্থান সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা দেওয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব। সন্ত্রাসীরা ম্যাপে লাল কালি দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত পথ দেখিয়ে বলল, এই রুট দিয়ে যেতে হবে।
তখন পাইলট প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন যে ঢাকা বিমানবন্দর সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। ফলে সেখানে অবতরণ করা নিরাপদ হবে না। তখন ছিনতাইকারীরা ঢাকা শহরের ম্যাপ বের করে দেখায়। তারাই বলে দেয় ঢাকার বিমানবন্দরের রানওয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বিস্তৃত এবং দৈর্ঘ্যে ৯ হাজার ফুট।
জাপানি প্রতিমন্ত্রী লিখেছেন, ছিনতাইকারী জঙ্গিরা নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে একে অন্যকে বিভিন্ন নম্বর ধরে ডাকতো। এই নামগুলো ছিল ১০ নম্বর, ২০ নম্বর, ৩০ নম্বর, ৪০ নম্বর, ৫০ নম্বর। কখনও কখনও তারা কাউকে কাউকে ২৫ ও ৩০ নম্বর বলেও ডাকতো।
২৮শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিমানটি ঢাকার আকাশে পৌঁছায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অবতরণের অনুমতি না পাওয়ায় বিমানটি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আকাশে চক্কর দেয়। তারপর সাড়ে এগারোটার দিকে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের আদেশ উপেক্ষা করে বিমানটি রানওয়েতে নেমে আসে।
বাংলাদেশ সরকার সাথে সাথে বিমানবন্দরটি বন্ধ করে দেয় এবং বিমানের আশেপাশে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক শ’ সেনা মোতায়েন করে।
কারা ছিনতাই করেছিল
জাপানের উগ্র বামপন্থী গোষ্ঠী জাপানিজ রেড আর্মি এই বিমানটিকে ছিনতাই করেছিল। তাদের দাবি ছিল জাপানে কারারুদ্ধ রেড আর্মির সদস্যসহ ৯ জন ব্যক্তির মুক্তি এবং ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
এই জঙ্গি গ্রুপটি ১৯৭০ এর দশকে জাপানে খুবই সক্রিয় ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল জাপানে বিপ্লব ঘটানো ও সারা বিশ্বে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা করা। জাপানিজ রেড আর্মি জাপানের বাইরেও তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছিল। বিদেশের কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে মিলে তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলাও চালিয়েছিল।
তার মধ্যে ছিল ১৯৭২ সালে তেল আবিবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোমা হামলা, যাতে ২০ জনেরও বেশি নিহত হয়। ১৯৭৫ সালে তারা কুয়ালালামপুরে মার্কিন দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে অর্ধশত ব্যক্তিকে চারদিন ধরে জিম্মি করে রেখেছিল।
ঢাকায় বিমানটি অবতরণ করার পরপরই রেড আর্মির প্রচারিত বিবৃতিতে ঘোষণা করা হয় যে তাদের ঢাকা-কমান্ডো গ্রুপ বিমানটিকে ছিনতাই করেছে। এই বিবৃতিতে ৮০ হাজার পাউন্ডের পেট্রল সরবরাহের দাবি করা হয়।
২৯ তারিখে জাপান সরকার ঘোষণা করে যে রেড আর্মির নয়জন কারাবন্দীকে মুক্তি ও মুক্তিপণ দিতে জাপান সরকার রাজি হয়েছে। তখন ছিনতাইকারীরা বলে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে।
সেদিন দুপুরে পাঁচজন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কিন নাগরিক কার্ট ক্রুগার, যার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।
দর কষাকষি
প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকারের নীতি ছিল রক্তপাত এড়িয়ে নিজেদের হাতে ঘটনার দ্রুত সমাধান করা। এর আগে জাপান সরকার গোপনে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছিল জাপান থেকে সন্ত্রাস দমনের জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী পাঠানোর। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান মাহমুদের মাধ্যমে ছিনতাইকারীদের সাথে জাপান সরকারের আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।
পয়লা অক্টোবর সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে জাপানের সরকারি প্রতিনিধি দল। ওই দলে ছিলেন ৩৯ জন। এছাড়াও জাপান এয়ারলাইন্স থেকেও ২৯ জনের একটি দল ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
হাজিমে ইশিই যে বিমানে করে ঢাকায় আসছিলেন তাতে নেওয়া হয়েছিল ৬ জন কয়েদিকে। রেড আর্মি যে মুক্তিপণ দাবি করেছে সেটা মেটাতে নগদ টাকায় ৬০ লাখ ডলারও তিনটি বস্তায় করে তোলা হয় বিমানের ভেতরে।
জাপানি প্রতিনিধি দলকে সাথে নিয়ে বিমানটি ঢাকায় অবতরণ করে ১লা অক্টোবর। এই বিমানটির পাশেই ছিল ছিনতাই হওয়া বিমানটি। সেসময় বাংলাদেশী সৈন্যরা এই বিমানটিকেও ঘিরে ফেলে। তাদের লক্ষ্য ছিল বিমানে সংরক্ষিত টাকা ও সাবেক কয়েদীদের আততায়ীর হাত থেকে রক্ষা করা।
হাজিমে ইশিই লিখেছেন, জাপান সরকারের প্রতিনিধি দল ঢাকায় যাচ্ছে এই খবর পেয়েই জঙ্গিরা আলোচনায় আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন মাহমুদের সাথে জঙ্গিদের যোগাযোগের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে।
তিনি লিখেছেন, এই পর্যায়ে মাহমুদ নিজের ইচ্ছেমতো দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। জাপান সরকারের পরামর্শ তিনি আদৌ শুনতে চাননি।’
হাজিমে ইশিইর সাথে যখন মাহমুদের পরিচয় হয় তখন মাহমুদ নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে ছিনতাইকারীদের সাথে যোগাযোগ করছিলেন। মাহমুদ সম্পর্কে ইশিই লিখেছেন, ‘গত তিনদিন নাকি একদম না ঘুমিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ চালাচ্ছেন। কিন্তু তার ওপর ক্লান্তির কোনো রকম ছায়া পড়েনি।’
ইশিইর উপস্থিতিতে মাহমুদ ছিনতাইকারী জঙ্গিদের সাথে কথা বলেন। এসময় তাদের মধ্যে ৫২ থেকে ৫৩ জন জিম্মিকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কথাবার্তা হয়। কিন্তু মাহমুদ আরো বেশি সংখ্যক যাত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন। কিন্তু জঙ্গিরা তাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৮২ জনকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়।
এর কিছুক্ষণ পর ছিনতাইকারীদের সাথে মাহমুদের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। হাজিমে ইশিই তখন মাহমুদকে জানান যে তিনি যেভাবে ব্যাপরটাকে এগিয়ে নিতে চাইছেন, সেটা জাপানের নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মাহমুদ চাইছিলেন কিছু যাত্রীর এখানেই মুক্তি দেওয়া হোক। আর বাকিদের অন্য জায়গা নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেও চলবে। কিন্তু জাপান সরকার চাইছিল সবাইকে ঢাকাতেই মুক্ত করতে।
তিনি লিখেছেন, মাহমুদ আমাকে বললেন ঘটনার সূত্রপাতের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দর-কষাকষি করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমি তাদের আস্থা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি। তারা যখন কথা দিয়েছে যে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর অবশিষ্ট জিম্মিদের অবশ্যই ছেড়ে দেওয়া হবে, তখন তাদের কথা বিশ্বাস করলে চলতি সমস্যার আশু সমাধানের পথ সুগম হবে।
এসময় তাদের দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও তিনি জানান।
জিম্মি হতে চান ইশিই
হাজিমে ইশিই জানান, ইতোমধ্যে জাপান সরকার মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ২১টি দেশ এবং যাত্রীদের নিজ নিজ দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানটি গ্রহণের অনুরোধ করে কিন্তু কোন দেশ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় নি।
ইতোমধ্যে জঙ্গিরা জিম্মিদের একে একে মেরে ফেলবে বলে ঘোষণা দেয়।
সেসময় হাজিমে ইশিই নিজেই মাইক্রোফোন নিয়ে ছিনতাইকারীদের সাথে কথা বলতে শুরু করেন। জাপানি ভাষায় তিনি তাদেরকে বলেন, বিমানের ভেতরে থাকা সব যাত্রীর বিনিময়ে আমাকে নতুন জিম্মি হিসেবে নিন।
কিন্তু তার সেই প্রস্তাব জঙ্গিরা গ্রহণ করেনি। বরং বিমানটি রানওয়ের মাঝামাঝি জায়গায় চলে যায়। তখন বিমানটিকে বাধা দেওয়া হলে ককপিটের জানালা খুলে একজন জঙ্গি পিস্তল বের করে চারটি গুলি ছোড়ে। এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দু'জন সৈন্য আহত হন।
বন্দী বিনিময় শুরু
পরে ছিনতাইকারীদের সাথে আবার আলোচনা শুরু হলে তারা বিমানটির মুখ ঘুরিয়ে আগের স্থানে চলে যায়। তারপর কিছুক্ষণ আলোচনার পর শুরু হয় জিম্মি যাত্রীদের মুক্তির প্রক্রিয়া।
ওই রাতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকেও ফুকুদার সাথে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা হয় টেলিফোনে।
পয়লা অক্টোবর রাত ১০টার দিকে একজন কয়েদি ও ২০ লাখ ডলারের বিনিময়ে ১০ জন নারী যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়। এক জটিল আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিনিময়ের কাজ চলে। জেলখানা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত অপরাধী ও নগদ অর্থ প্রথমে জাপানের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর সেই লোকজন ও অর্থ ছিনতাই হওয়া বিমান পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া এবং জঙ্গিদের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের ওপর বর্তায়।
তখন ছিনতাইকারীরা টাকা গুণে এবং জাপানি কয়েদিদের বুঝে নিয়ে কয়েক দফায় ৬১ জন যাত্রীকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তখনও থেকে গিয়েছিল ৭১ জন যাত্রী ও ৯ জন ক্রু। ছিনতাই এর ঘটনা শুরু হওয়ার পর ততক্ষণে তিনদিন ১৮ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে।
সামরিক অভ্যুত্থান
হাজিমে ইশিই লিখেছেন, পরদিন ভোর পাঁচটার দিকে তিনি বাজুকা কামান ও মেশিনগানের শব্দ শুনতে থাকেন। কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারেন নি যে কী হচ্ছিল। কিন্তু পরে তিনি জানতে পারেন যে ঢাকা বিমানবন্দর সেসময় প্রায় বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু মি. মাহমুদ তাকে কিছু বুঝতে দেননি।
পরিস্থিতি এমন উত্তেজনাপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও আমরা বুঝতে পারিনি যে একই ভবনের ভেতরে হত্যাকাণ্ডে চলছে। রাত পার হয়ে সকাল হলে সবকিছু যখন পরিষ্কার দেখা যেতে শুরু করে, তখন প্রথম আমরা জানতে পেরেছিলাম পরিস্থিতির ভয়াবহতা।
তিনি আরো লিখেছেন, টার্মিনাল বিল্ডিং, মূল ভবনের ভেতরটা রক্তের সাগরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহী সৈন্যরা সেখানে মোতায়েন বিমানবাহিনীর সেনাদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে।
বিদ্রোহী সেনারা সকাল পৌনে সাতটার মধ্যে বিমানবন্দরের মূল ভবনকে তাদের দখলে নিয়েছিল। সেসময় তিনি কিছু রক্তাক্ত মৃতদেহ এখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখেন। এসময় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়।
সশস্ত্র বাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে সকাল আটটার দিকে। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যরা মূল ভবনে প্রবেশ করলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। তারপর ধীরে ধীরে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়।
হাজিমে ইশিই লিখেছেন, এই ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল স্থল ও বিমানবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সেপাই। এতে বিমানবাহিনীর একজন অফিসারসহ ২১ জন অফিসার ও সেনা নিহত হন। বিদ্রোহী সেনা মিলে মোট ২০০ জনের বেশি এই ঘটনায় প্রাণ হারান বলে জানা গেছে।
হঠাৎ বৃষ্টি
অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা দমন করার পর বিমান ছিনতাইকারী জঙ্গিদের সাথে আবারও আলাপ আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে তাদের কথাবার্তা অনেকটাই নরম হয়ে আসে। তখন হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়।
২রা অক্টোবর সকালে হাজিমে ইশিই জাপানি প্রধানমন্ত্রী ফুকুদার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল বলে তিনি তাকে অনুরোধ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে।
পরে তিনি উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সাথে দেখা করতে তার বাসভবনে যান। বিচারপতি সাত্তার তাকে আশ্বস্ত করেন যে সবকিছু দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
হাজিমে ইশিই আবার বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে ফিরে আসেন। দুপুরের দিকে আবার নতুন করে দর কষাকষি শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিকাল সোয়া পাঁচটায় তারা আরো ৪২ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রুকে ছেড়ে দেয়।
বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি
ওই দিন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক আইন শাসক হিসেবে রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেন।
কিন্তু তার আগে পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে বদলে যেতে শুরু করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ফোন করে কন্ট্রোল টাওয়ারে। তিনি আদেশ দেন বিমানটিকে অনতিবিলম্বে ঢাকা ত্যাগ করতে দেওয়ার জন্য।
জঙ্গিদের জানানো হয় তাদের এখনই ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন বিমানটিকে আটকে রাখার জন্যে দাঁড় করিয়ে রাখা দমকল বাহিনীর গাড়িগুলো সরে যেতে শুরু করে।
হাজিমে ইশিই তখন খুব ভেঙে পড়েন। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না। জঙ্গিদের জানানো হয় বিমানের ভেতরে এখনও যে ২৯ জন আরোহী রয়ে গেছেন তাদের বিনিময়ে হাজিমে ইশিই নিজে জিম্মি হতে রাজি। কিন্তু এই প্রস্তাব আবারও প্রত্যাখ্যাত হয়।
নতুন গন্তব্যে
তারপর বিমানটি উড়ান শুরু করে নতুন গন্তব্য আলজেরিয়ার উদ্দেশ্যে।
রানওয়ের শেষ প্রান্তে এসে বিমানটি যেন জাদুর বলে আকাশে ভেসে যায়। বিশাল এক পাখির মতো নিঃশব্দে রাতের আকাশে উড়ে তারপর মেঘের ভেতরে মিলিয়ে যায়, লিখেছেন হাজিমে ইশিই।
আকাশ থেকে ছিনতাইকারীরা বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে যে তাদের মিশন সফল হয়েছে। বিমানটি কালো মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছে বলে তার দেখা আর মিলল না। শুধু দুষ্কৃতকারীর কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের ঘরে সজোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
৩রা অক্টোবর সকালে বিমানটি গিয়ে পৌঁছায় কুয়েতে। তখন কুয়েতে দিবাগত রাত ১টা ৪৩ মিনিট। সেখানে ৬০ হাজার পাউন্ডের তেল নেওয়ার পর বিমানটি ২৯ জন আরোহী ও জঙ্গিদের নিয়ে বিমানটি কুয়েত ত্যাগ করে।
এবার বিমানটি গিয়ে পৌঁছায় সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। সেখানে আরো ১০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখনও থেকে যায় ১৯ জন।
সেদিনই স্থানীয় সময় বিকেল চারটার পর বিমানটি আলজিয়ার্সের উপকণ্ঠে আল বাইদা শহরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে ছেড়ে দেওয়া হয় বাকি জিম্মিদের।
এই প্রতিবেদনটি হাজিমে ইশিই-এ র বই এর উপর ভিত্তি করে তৈরি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা