২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯ ফাল্গুন ১৪৩০, ২২ শাবান ১৪৪৬
`

বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবি এসেছিল যেভাবে

- ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই ১২০০ মাইলে দূরত্বে দেশটির দুই অংশের মধ্যে ভাষা নিয়ে বিরোধ দানা বেঁধে ওঠে। এর জের ধরে যে লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল, তার ফলে ১৯৫৬ সালে দেশটির প্রথম শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলেছিল।

ভাষা সংগ্রামবিষয়ক গবেষকদের মতে, ভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আগেই। তখন মূলত সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই বাংলাকে এই অঞ্চলের সরকারি ভাষা করার জন্য দাবি উঠতে শুরু করেছিল।

দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকিট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হলে এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে।

সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা কিংবা উর্দু ও ইংরেজির সাথে সরকারি ভাষা করার দাবি তুলে ধরেছিলেন।

দেশ ভাগের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের শুরুতে বিষয়টি পাকিস্তানের গণপরিষদের আনুষ্ঠানিক উপস্থাপন করেছিলেন তখনকার বাংলার প্রতিনিধিদের একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

তিনি ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি করেছিলেন বলে জানিয়েছেন ভাষা আন্দোলনবিষয়ক গবেষক ড. এম আবদুল আলীম।

তিনি বলেন, ‘১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে শুধু ইংরেজিই সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহারের বিধান ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগের একজন সদস্য তাতে একটি সংশোধনী এনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুকে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। সেখানেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আরেকটি সংশোধনী এনে ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলাকেও যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।’

তার মতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবকে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানসহ অন্যরা অগ্রাহ্য করার পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রাজপথে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করে।

পরে এই আন্দোলনই তীব্র হতে শুরু করে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’-এমন ঘোষণার পর।

এরপর ধারাবাহিক সংগ্রাম চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তবে দাবিটি বাস্তবায়ন হতে সময় লেগেছে আরো চার বছর।

বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ও রাজনৈতিক উদ্যোগ
ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বিভিন্ন বইতে লেখক ও গবেষকরা যে ধারণা দিয়েছেন সে অনুযায়ী, বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটি একইসাথে দুটি ধারায় গড়ে উঠেছে। এর একটি এসেছে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ থেকে, আর অন্য দিকটি হলো রাজনৈতিক।

বুদ্ধিবৃত্তিক অংশটি এ দাবিটি তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের স্বাধীনতার আগে থেকেই।

১৯৪৭ সালের জুনে ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে জুলাই মাসেই ঢাকায় গণ-আজাদী লীগ নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়।

তারা তাদের ঘোষণায় শিক্ষা ও ভাষার বিষয়ে যে দাবি করেছিলেন তা বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খসড়া ম্যানিফেস্টোতেও ছিল। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তখনকার সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলে উপস্থাপনের জন্য ১৯৪৬ সালে সেই খসড়া ম্যানিফেস্টো তৈরি করেছিলেন।

লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর তার ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইতে লিখেছেন, ‘আলোচ্য ঘোষণাটিতে মাতৃভাষা, শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। যেমন: মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে এবং বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এই ভাষাকে যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’

মূলত এরপর থেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ও ছাত্রদের মধ্যে বাংলা ভাষাকে নিয়ে তৎপরতা বাড়তে শুরু করে।

বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা, সভাসমিতি ইত্যাদি ব্যাপারে প্রথম থেকেই বেশ কিছুটা সক্রিয় হয়।’

এই সংগঠনটিই তাদের পুস্তিকায় প্রস্তাব করে, ‘বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা ও অফিসের দাফতরিক ভাষা। কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি- উর্দু ও বাংলা। বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা।’

পরে এই তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

আর বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ থেকেই জোরাল হওয়া দাবিটি পাকিস্তানের স্বাধীনতার ছয় মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের গণপরিষদে নিয়ে এসেছিলেন তখনকার বাংলার প্রতিনিধিদের একজন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

বদরুদ্দীন উমর তার বইতে গণপরিষদের ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব অংশে লিখেছেন, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে বিরোধী দল দু’টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাবটিতে বৎসরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল ভাষাবিষয়ক। এটিতে উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।’

পরে বিভিন্ন পর্যায়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মোট তিনটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন গণপরিষদে, যার প্রতিটিতেই বাংলাকে সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব ছিল।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি উত্থাপনের এক দিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়। প্রস্তাবটির তীব্র বিরোধিতা করেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান।

তিনি বলেন, ‘এখানে এ প্রশ্ন তোলাই ভুল হয়েছে। এটা আমাদের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। আমি অত্যন্ত তীব্রভাবে এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করি এবং আশা করি যে এ ধরনের একটি সংশোধনী প্রস্তাবকে পরিষদ অগ্রাহ্য করবেন।’

গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তি সংশোধনী প্রস্তাবটির সমর্থন করে বলেন, ‘বাংলাকে আমরা দু’অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য কোনো চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজিকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।’

বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ‘পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংশোধনীর প্রস্তাবটির বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বেশিভাগ অধিবাসীরই এই মনোভাব যে একমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।’

শেষ পর্যন্ত গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার খবর ঢাকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ছাত্র, রাজনীতিক ও শিক্ষিত মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে মিছিল বের করেন। ওই মিছিল শেষে সভায় সভাপতিত্ব করেন তমদ্দুন মজলিশের আবুল কাশেম।

ড. এম আবদুল আলীম বলেছেন, ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটিই ছিল বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব। পরে পাকিস্তানের শাসকরা ১৯৫৬ সালে দেশটির প্রথম শাসনতন্ত্রে উর্দুর সাথে বাংলাকেও সরকারি ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল, যার মাধ্যমে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।

বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় প্রবল গণআন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অনেকে মারা যাওয়ার পর কার্যত পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না।

এই ঘটনার দু’বছরেরও বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।

ড. এম আবদুল আলীম বলেন, ‘এরও দু’বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়।’

এর আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মাঠে নেমেছিল ২১ দফার ভিত্তিতে, যেখানে বলা হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের মর্যাদা পাবে ও বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

আবদুল আলীমের মতে, মূলত ভাষা আন্দোলনের পক্ষেই আনুষ্ঠানিকভাবে ৫৪’র নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের মানুষ ম্যান্ডেট দিয়েছিল। পরে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এবং ঢাকায় মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর বক্তৃতা বাংলার পক্ষে তুমুল আন্দোলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল এ অঞ্চলের মানুষকে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
আবারো বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষা দেবেন সাকিব ঢাবিতে শহীদ দিবস উপলক্ষে সম্মিলিত নারী প্রয়াসের আলোচনা সভা ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ইবিতে মানববন্ধন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে দেয়া হবে না : জয়নুল আবেদীন বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে : ভিসি ড. আমানুল্লাহ বিচার বিভাগ সংস্কার কার্যক্রমে একটি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে : প্রধান বিচারপতি এ বছরের মধ্যেই নির্বাচন শেষ করুন : মাহবুব উদ্দিন খোকন ইংল্যান্ডের রেকর্ড সংগ্রহ, বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অস্ট্রেলিয়া মালয়েশিয়ায় ১৩ দেশের শিল্পী ও নাগরিকের অংশগ্রহণে মাতৃভাষা দিবস পালন ডিভাইস আসক্তি থেকে ফেরাতে রাজধানীতে শিশুমেলা সুনামগঞ্জে যুবলীগ নেতা গ্রেফতারে বিএনপির দু’পক্ষের উত্তেজনা, ১৪৪ ধারা জারি

সকল