৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩০ রজব ১৪৪৬
`

মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ সানজিদার চিকিৎসা টাকার অভাবে থমকে আছে

- ছবি : বাসস

‘আমাগো বাসার কাছাকাছি একটা ক্লিনিকে আগুন লাগে, পুলিশ মানুষেরে গুলি করে, মানুষ পুলিশরে দেয় ঢিলা। অনেক ঝামেলা চলতাছিল রাস্তায়। চারপাশে উড়তেছিল হেলিকপ্টার। আমার নাতিনডা বারান্দায় দাঁড়ায় ছিল। বারান্দায় দাঁড়াইয়া রাব্বি (সাবলেট ভাড়াটিয়া) আর ওয় বাইরের এসব দেখতাছিল। এর মধ্যে হঠাৎ আমাগো বিল্ডিংটায় খই যেমনে ফুটে, এমন আওয়াজ হওয়া শুরু হইল। আমি ঢরে শেষ। এর মধ্যে বারান্দা থেকে আমার মাইয়া ডাইনিং রুমে আইসা নিচে পড়ে গেল। মাইয়া বলে, মাগো আমার পিঠডা ঢলায় দেও। পিছনে তাকায় দেখি রাব্বি মাটিতে পইড়া আছে। কিছু বুঝার আগেই দেখি দু’জনের রক্তে ঘর ভাইসা গেছে। হাউমাউ করে চিৎকার করা শুরু করলাম। যখন মাইয়ার চোখ উল্টায় গেল, মনে করছি, মাইয়া আর পৃথিবীতে নাই। মানুষে মানুষে আমাগো বিল্ডিং ভরে গেল। কিন্তু কোন একটা মানুষ আমাগো সাহায্য করে নাই। সবাই ভয়ে যার যার ঘরে চইলা গেল।’

গত ২০ জুলাই বিকেলে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে আহত সানজিদা ইসলামের (২০) মা আমেনা বেগম তার ঘরে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা বলছিলেন।

আহত সানজিদা সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাজিল এলাকার বাসিন্দা। ওই এলাকার স্থানীয় নজরুল ইসলামের ছয়তলা বাড়িতে ভাড়া থাকেন। স্বামী মো: রানার (৩০) সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে আলাদা হয়ে তিনি মায়ের সাথে বসবাস করেন। তার বাবা নেই। সানজিদার মা আমেনা বেগম (৪০) গৃহকর্মীর কাজ করেন। সানজিদার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মিম ও তার মাকে নিয়েই তার পরিবার।

ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আহত সানজিদা বলেন, ‘বাড়ির পাশের বিল্ডিং এ হঠাৎ আগুন লাগে। পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি ছুঁড়লে সবাই আমাদের বাসার নিচে আসতাছিল। বাইরের পরিস্থিতি দেখে ভয়ে আমি মিমকে বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে আনতে গিয়েছিলাম। ওরে নিয়ে যেই আমি রুমের ভেতরে ঢুকতে যাই, তখনি আমার কোমরে গুলি লাগে। কিডনি থেকে আধা ইঞ্চি নিচে আমার গুলি লাগছে। আমার যা হওয়ার হইছে, আল্লায় আমার মাইয়াটারে বাঁচাইছে। কয়েক সেকেন্ড আগে হলে এই গুলি আমার মাইয়ার গায়ে লাগত। মেয়ের যেন কিছু না হয় তাই মেয়েরে আনতে গিয়েছিলাম। কে জানত নিজের ঘরে থেকেও গুলি খেতে হবে। আমি তো গুলি লাগার পর ডাইনিং রুম পর্যন্ত আসতে পারছি, কিন্তু আমাদের সাবলেট রাব্বি ভাই সাথে সাথে সেখানেই মারা গেছেন।’

সানজিদার মা আমেনা বেগম মেয়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘মেয়েরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাইতেও অনেক কষ্ট হইছে। রিকশাওয়ালারাও ভয়ে যাইতে চায় নাই। বড় রাস্তায় তো ঝামেলা, গলি দিয়ে মাইয়ারে সাইনবোর্ডের একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়া গেলাম। ওখানের ডাক্তাররা মাইয়াটারে দেখতেও চায় না। তারা ঘণ্টা খানেক পরে ওর কাছে আসে, আইসা বলে ওর পেটে গুলি নাই। আমি কাইন্দাকাইট্টা বললাম, একটা এক্স-রে করেন। পরে এক্স-রে করে দেখে গুলি আছে। এরপর তারা গুলি বের করে। বাসায় নিয়া আইলাম মাইয়ারে। অন্ধকার ঘরে তখনো রাব্বির লাশ মাটিতে পড়ে আছে। রাত ৩টা পর্যন্ত রক্তাক্ত লাশের সামনে বইসা ছিলাম। শেষ রাতে জামালপুর থেকে রাব্বির পরিবারের মানুষ আইসা ওর লাশ নিয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গুলি লাগার ১১ দিন পরেও অতিরিক্ত ব্যথায় চিৎকার পারত মাইয়াটা। পরে ডাক্তার বলল, পেটে গুলির বারুদ আছে। অপারেশন করা লাগবে। ডাক্তার বলছে, ওর সুস্থ হইতে অনেকদিন সময় লাগবে। এখনো প্রায়ই ব্যথায় ছটফট করে।’

এদিকে অর্থের অভাবে থমকে আছে সানজিদার চিকিৎসা। আমেনা বেগম জানান, এখন পর্যন্ত সানজিদার চিকিৎসা বাবদ প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

সম্প্রতি চিকিৎসক তার শারীরিক অবস্থা দেখে রোগনির্ণয় পরীক্ষার পরামর্শ দেন। কিন্তু অর্থের অভাবে পরীক্ষা না করিয়ে পরিচিত ফার্মেসী থেকে ধারে ব্যথানাশক ওষুধ খাচ্ছেন সানজিদা।

সানজিদা বলেন, ‘প্রায় সময় পেটে প্রচুর ব্যথা হয়। ব্যথায় জ্বর চলে আসে। এজন্য ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে বলেছে। কিন্তু পরীক্ষা করার জন্য টাকা নাই। বেশি ব্যথা করলে ফার্মেসী থেকে ধারে এনে ওষুধ খাচ্ছি।’

নিজেদের জীবনের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে আমেনা বেগম বলেন, ‘অভাবে অভাবেই জীবন কাটছে। মেয়ের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন ওর বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেছিলাম। মদ-গাঁজা খাইয়া ওর বাবায় আমারে আর মাইয়ারে মারত। এই একটা মাইয়ারে নিয়ে জীবনডা কাটাই দিছি। মানুষের বাসায় কাজ করে যা পাই, তা দিয়েই সংসার চালাই। অভাব থাকায় মাইয়াডারে অল্প বয়সে বিয়া দিছিলাম। মাইয়াডার কপাল আমার মতোই পোড়া। মাইয়ার জামাই মাইয়ারে অনেক মারে। একটা মাত্র মাইয়া আমার। ওয় ছাড়া আর কে আছে আমার? আমরা কোনো রকমে খাইয়া পইরা ভালোই ছিলাম। কিন্তু ধার-দেনা করে ওর চিকিৎসা করে আমি এখন নিঃস্ব। আমার কোনো আত্মীয় আমারে তেমন উপকার করে নাই। আমি আর চিকিৎসা করাতে পারতাছি না। ঢাকার কোনো হাসপাতাল আমি চিনিও না। আমার মেয়ের মতো যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে তাদের সব চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব সরকারের নেয়ার দাবি জানাই।’

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ২০ হাজার টাকা আর জামায়াত ইসলাম থেকে ১০ হাজার টাকার সাহায্য পাওয়ার কথা জানান তিনি।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘এই টাকা মেয়ের চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে। ওর চিকিৎসা করতে টাকা লাগবে। চিকিৎসা না করতে পারলে আমার মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়? আমার বয়স হয়ে গেছে। আমার নাতিনের মা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ নাই।’ সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement