‘কেউ আর জিজ্ঞাসা করে না, আম্মু তোমার কিছু লাগবে কি না?’ শহীদ রাব্বির মা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:৫৯
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ আকরাম খান রাব্বি স্বপ্ন দেখতেন, তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করবেন। মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের পথেই ছিলেন রাব্বি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা চাকরি করতেন। কিন্তু বুলেটের আঘাতে তার সেই যাত্রা থেমে গেছে চিরতরে।
গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাব্বি। শেষবারের মতো তার মুখটাও দেখতে পারেননি কেউ।
রাজধানীর মিরপুর ১৩-এর কাফরুল থানার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বাইশটেকের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ আকরাম খান রাব্বির বাবা মো: ফারুক খান এসব কথা বলেন।
শহীদ আকরাম খান রাব্বির বয়স হয়েছিল ২৮ বছর। তিনি রাজধানীর ক্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন। পাশাপাশি ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়ের শো-রুমে চাকরি করতেন। রাব্বির বাবা ফারুক খান (৫৪) ও মা বিউটি আক্তার (৪৫)। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাব্বি ছিলেন মেজ। বড় ভাই ব্যবসায়ী ইমরান খান রকি (৩২) আর ছোট ভাই মেহেদী হাসান রাফি (২১)। রাফি এ বছর এইচএসসি পাস করেছেন। রাব্বি ১৯ জুলাই শহীদ হলেও তিনদিন পর ২১ জুলাই সন্ধ্যায় মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
রাব্বির বাবা ফারুক খান বলেন, ‘আমার ছেলে শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল। অফিসের ফাঁকে ফাঁকে আন্দোলনে যোগ দিত। সে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে আন্দোলনকারীদের পানি, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার কিনে খাওয়াতো।’
ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। রাব্বি দুপুরে বাসা থেকে জুম্মার নামাজ পড়তে বের হয়। নামাজ শেষে আন্দোলনে যোগ দেয়। বিকেল ৪টা ১৭ মিনিটে মিরপুর ১০ এ শহীদ আবু তালেব স্কুলের সামনে তার পেটে ও বুকে গুলি লাগে। সাড়ে ৪টার দিকে ওর বন্ধু আমাকে কল করে জানায়, রাব্বির গুলি লাগছে। আমরা ওকে ১১ নম্বরের ইসলামিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তখন আমি বাসা থেকে বের হয়ে মিরপুর ১১ নম্বরের দিকে যেতে থাকি, এই সময় তার বন্ধু আবার আমাকে কল করে জানায়, এই হাসপাতালে রাব্বিকে চিকিৎসা দেবে না। তাই ওকে আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি ঢাকা মেডিক্যালে আসেন। আমি যখন অনেক কষ্ট করে ঢাকা মেডিক্যালে যাই, গিয়ে দেখি আমার বাবাটার লাশ ফ্লোরে পড়ে আছে। ওর গায়ের গেঞ্জিটা রক্তে ভেজা।’
ফারুক খান আরো বলেন, ‘আমি লাশ নিয়ে আসতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে আমার ছেলের লাশ দিতে আস্বীকৃতি জানায়।’
তারা বলেন, ‘উপরের নির্দেশ আছে, লাশ এখন দেয়া যাবে না।’ তখন আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে লাশ হিম ঘরে রেখে রাতে বাসায় ফিরে যাই। পরের দিন ২০ তারিখ সকালে লাশ নিতে এসে দেখি রাব্বির লাশ বাইরে পড়ে আছে। লাশ নেয়ার জন্য আমি ২০ তারিখ সারাদিন অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। অবশেষে ২১ তারিখ অনেক চেষ্টা করে, আমি রাব্বির লাশ বুঝে পাই। তিনদিন বাইরে পড়ে থাকার কারণে লাশ পচে গিয়ে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় জানাজা শেষে, মিরপুরের পূর্ববাইশটেক কবরস্থানে রাব্বিকে দাফন করা হয়।
রাব্বির বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ছেলে হারানোর যন্ত্রণা কী, আমি এখন বুঝতে পারছি। আমার কষ্ট, বিদায় বেলায় আমার সন্তানের মুখটাও কেউ দেখতে পারলো না। রাব্বির লাশ হিম ঘরে রাখার জন্য আমি টাকা দিয়ে এলাম, কিন্তু লাশ বাইরে ফেলে রাখা হলো। তিনটা দিন আমার বাবাটার লাশ বাইরে পড়ে ছিল। এমন কি যখন আমি সন্তানের জানাজায় দাঁড়িয়েছি, তখন পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেফতার করতে। স্থানীয় জনগণের বাধায় আমাকে সেদিন পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।’
শহীদ আকরাম খান রাব্বির মা বিউটি আক্তার বলেন, ‘শুরু থেকেই রাব্বি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। ১৮ তারিখ দুপুরে বাসায় আমরা এক সাথে ভাত খাই। এরপর বিকেলে সে গিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে পানি কিনে খাওয়ায়। রাতে বাসায় ফিরে আমাদের কাছে এই বিষয়ে গল্প করে। আমি ও ওর আব্বু আন্দোলনে অংশ নিতে নিষেধ করি। পরের দিন ১৯ জুলাই দুপুরে জুম্মার নামাজ পড়তে রাব্বি বাসা থেকে বের হয়। সাড়ে ৪টার দিকে ওর আব্বুর মোবাইলফোনে এক বন্ধু জানায়, রাব্বির গুলি লাগছে। তখন ওর আব্বু তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আমি ওর আব্বুকে বলি আমার বাবাটার কি হয়েছে, কোথায় গুলি লাগছে? ওর আব্বু আমাকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। একটু পরে রাব্বির বন্ধু কল করে আমাকে বলে, ‘আন্টি চিন্তা করবেন না, রাব্বির হাতে গুলি লাগছে।’
তিনি বলেন, ‘সারা বিকেল চলে গেল, রাত ১১টা বেজে যায়, আমি আমার বাবাটার কোনো খবর পাই না। রাত ১২টার দিকে ওর বাবা বাসায় ফেরে। আমি দরজা খুলে দিতেই ওর বাবার গা থেকে আতরের গন্ধ পাই। তখন আমি বুঝে ফেলি আমার বাবা আর নেই। তারপরও রাব্বির বাবাকে বলি তোমার শরীরে আতরের গন্ধ কেন? তাহলে আমার রাব্বি কি আর নেই? তখন ওর বাবা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। পরে তিন দিন অপেক্ষা করি, ছেলের লাশের জন্য, আমার বাবাটাকে একনজর দেখার জন্য। সবাইকে কত অনুরোধ করলাম আমাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে, কিন্তু কেউ আমাকে মেডিক্যালে নিয়ে গেল না। পরে ২১ তারিখে যখন শুনলাম আজ আমার বাবার লাশ নিয়ে আসা হবে। তখন আমি সকাল থেকে বাসার নিচে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার বাবাটাকে একটু দেখবো, একটু আদর করবো, শেষবারের মতো একটু চুমু খাবো। কিন্তু এমন হতভাগ্য মা আমি, আমার ছেলের লাশটাও দেখতে পারিনি। আমার জীবনটাই বৃথা।’
বিউটি আক্তার বলেন, ‘রাব্বি অফিস থেকে বাসায় ফিরে আমাকে রান্না, বাসন মাজা, ঘর মোছাসহ বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করতো। আমার শরীর খারাপ হলে আমাকে কোনো কাজ করতে দিত না। আমার কখন কী লাগবে, সব সে এনে দিত। এখন আমাকে আর কেউ জিজ্ঞাসা করে না, আম্মু তোমার কিছু লাগবে কি না?।
ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে এমন ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে শহীদ রাব্বির বাবা ফারুক খান বলেন, ‘২০২৪ সালে এসে আন্দোলনে অংশ নিয়ে সারাদেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বৈরাচার মুক্ত দেশ পেয়েছি। আমি চাই ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার যাতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসতে না পারে। আবার যেন হাজার হাজার মায়ের বুক খালি না হয়। যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে যেন শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়। শুধু মুখে শহীদ বললে হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।’
একই সাথে এই আন্দোলনে সারাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন তাদের পূনর্বাসন করার দাবি জানান শহিদ রাব্বির বাবা।
কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ফারুক খান বলেন, জুলাই ফাইন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন আকরাম খান রাব্বি। বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সম্মিলিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন তিনি। এ ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট পল্লবী থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন বাবা ফারুক খান।
এ মামলায় ইতোমধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সূত্র : বাসস
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা