ছেলে আর ফিরবে না জেনেও ‘হালুয়া’ বানিয়ে অপেক্ষায় থাকেন মা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩
শহীদ পারভেজের শোকাহত মা কানিজ ফাতেমা প্রিয় ছেলের বিদায় দৃশ্য দেখার পরও এখনো প্রতীক্ষায় আছেন ছেলে ফিরবে। কিন্তু তার এ অপেক্ষা কখনো ফুরোবে না। এ কথা জেনেও তিনি একমাত্র ছেলের ডাক শোনার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করেন।
স্বৈরাচারী শাসক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ৫ আগস্ট বিকেলে নগরীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় হাজার হাজার মানুষের সাথে বিজয় মিছিলে যোগ দেয়ার সময় ৩১ বছর বয়সী গার্মেন্টসকর্মী পারভেজ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
একমাত্র অবলম্বন ও আনন্দের উৎস ছিল যে ছেলে, তাকে হারানোর শোকের বোঝা বয়ে বেড়ানো ফাতেমার জন্যে এখন দুঃসহ বিষয়।
নগরীর যাত্রাবাড়ির মাতুয়াইল পশ্চিমপাড়া এলাকার বাড়িতে এই সংবাদদাতার কাছে শহীদ ছেলের জন্য ফাতেমা তার যন্ত্রণার কথা জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি বলেন, ‘আমার প্রিয় ছেলের মৃত্যুর পর থেকে আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার মনে হয়, সে তার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আসবে এবং সে আগের মতোই আমাকে গেট খুলে দিতে বলবে।’
ছেলের কর্মস্থল থেকে ফেরার জন্য ফাতেমা প্রতি রাতে বাড়িতে অপেক্ষা করতেন। দু:খ ভারাক্রান্ত ফাতেমা বলেন, ‘আমার ছেলে রাতে বাসায় এসে মিষ্টি কন্ঠে ডাকতো ‘আম্মু, প্লিজ গেট খোলো, আমি ঘুমাবো’। কিন্তু এখন গেট খুলতে কেউ ডাকে না, তবুও আমি রাত জেগে তার জন্য অপেক্ষা করি।’
খুলনার এক দরিদ্র ও ভূমিহীন দম্পতি খোকন মিয়া ও ফাতেমা ৩০ বছর আগে যাত্রাবাড়ির মাতুয়াইল এলাকায় ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। পেশায় একজন নির্মাণশ্রমিক খোকন ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে ২৮ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন।
ছয় সন্তানকে বড় করে তোলার কষ্ট কিছুটা কমাতে তিনি তার দু’টি মেয়েকে দত্তক দিতে বাধ্য হন। তারপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই একমাত্র ছেলে পারভেজ এবং অন্য তিন মেয়েকে মানুষ করেন। তিনি তার সন্তানদের মধ্যে কঠোর পরিশ্রম এবং পারিবারিক নিষ্ঠার মূল্যবোধ জাগিয়েছেন।
ছয় ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট পারভেজ মাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার জন্য ১৪ বছর বয়সে কাজ শুরু করেন। তিনি মায়ের সবচেয়ে শক্তিশালী অবলম্বন ছিলেন। এমনকি তিনি তার মার যত্ন নিতে অস্বীকার করায় তার স্ত্রীকে তালাক পর্যন্ত দিয়েছিলেন।
সীমাহীন কষ্টে দিশেহারা ফাতেমা নিজের কপাল চাপড়ে বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছি। কিন্তু আমার ছেলে সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং আমাকে সুখের স্বাদ দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমার কপালে সে সুখ সইলো না।’
পারভেজকে একজন কর্মঠ ও নিঃস্বার্থ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে ফাতেমা বলেন, ‘আমার ছেলে তার সামান্য উপার্জন সত্ত্বেও সবসময় আমার সুখের দিকে খেয়াল করতো। আমার যত্ন নিতো।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন মেটাতে এবং আমাদের সুখী করতে সে অক্লান্ত পরিশ্রম করতো এবং ছুটির দিনেও কাজ করতো। সে তার সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও বোনদের খোঁজ-খবর নিতো এবং তাদের প্রয়োজন মেটাতো।’
তার প্রতি পারভেজের ভক্তির কথা স্মরণ করে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে আমাকে অনেক ভালোবাসত। সে লাউডস্পীকারে ‘খোদার পরে এই অন্তরে আছেন আমার আম্মা’ গানটি বাজাতো। আমি কি হারিয়েছি তা একমাত্র আল্লাহ এবং আমি জানি।’
মৃত্যুর আগে ছেলেকে পছন্দের খাবার খাওয়াতে না পারায় মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন ফাতেমা। তিনি ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘মৃত্যুর আগে, আমার ছেলে বুটের ডালের হালুয়া খেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি খুব অসুস্থ থাকায় তা তৈরি করে খাওয়াতে পারিনি। এখন আমার ঘরে হালুয়া আছে কিন্তু তা খাওয়ার মানুষ নাই।’
ফাতেমার একমাত্র অবলম্বন পারভেজের মৃত্যু তাকে কেবল মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত করেনি, ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটেও ফেলে দিয়েছে। কারণ পারভেজের বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা তাদের শ্বশুর বাড়িতে থাকেন।
ফাতেমাকে এখন বেঁচে থাকার জন্য তার মেয়েদের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
এ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ ১০ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৭২ হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছে।
ফাতেমার দুই পা ভেঙে গেছে এবং প্রতি মাসে তার ছয় হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এ কথা উল্লেখ করে ফাতেমা বলেন, ‘তিনি এখন জামায়াতের অনুদানের টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তার লভ্যাংশের টাকায় ওষুধের খরচ মেটাচ্ছেন।
আন্দোলনের দিনগুলোতে পারভেজের স্মৃতি স্মরণ করে ফাতেমা বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের দমন করায় তার ছেলে বিরক্ত ছিল। একদিন পারভেজ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কি কোনো যুবককে বাঁচিয়ে রাখবেন না? তিনি সব মানুষকে হত্যা করছেন। আমি গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু দেখেছি।’ ফাতেমা ওই সময় তাকে অফিসে যেতে বাধা দিয়েছিলেন।
তিনি জানান, প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারের পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গত ৫ আগস্ট বিকেলে তার ছেলে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর থেকে সে নিখোঁজ ছিল।
গত ৫ আগস্ট বিকেল থেকে ৬ আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি নিজেই আমার ছেলের খোঁজ করেছি। তাকে খুঁজে না পেয়ে বড় মেয়ে নাজমা আক্তার বৃষ্টির বাড়িতে গিয়ে তাকে জানাই, ’তিনি হৃদয় বিদারক এ ঘটনার কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ভাইকে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজির কথা স্মরণ করে বৃষ্টি বলেন, ‘আমরাও ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু পারভেজ যে যাত্রাবাড়ি গেছে তা আমরা জানতাম না।’
বৃষ্টি জানান, মায়ের কাছে হৃদয়বিদারক খবর শুনে তিনি ফোনে পারভেজের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে তারা তার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দেন।
বৃষ্টি তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে করতে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে মর্গে আরো অনেক লাশের মধ্যে আমার ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘মর্গের কর্মীরা জানান, তারা ৫ আগস্ট মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে ৩০০টিরও বেশি লাশ পেয়েছেন এবং তাদের মধ্যেই পারভেজের লাশ ছিল। তবে পারভেজের পরিবার হাসপাতাল থেকে লাশ বুঝে পেতে প্রতিকূলতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়।’
বৃষ্টি বলেন, ‘আমরা যখন আমার ভাইয়ের লাশ আনতে যাই, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ দিতে চায়নি, বরং তারা আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। অবশেষে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহায়তায় ৬ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার দিকে আমরা লাশ বুঝে পাই। ৭ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে মাতুয়াইল কবরস্থানে পারভেজকে দাফন করা হয়।’
পারভেজের শাহাদাতের সময় ও স্থান সম্পর্কে বৃষ্টির বর্ণনা থেকে জানা যায়, একটি ভিডিও দেখে এবং ডাক্তারি নথি বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে পারভেজকে যাত্রাবাড়ি থানার সামনে দুপুর আড়াইটার দিকে গুলি করা হয় এবং মুগদা হাসপাতালে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ি থানা থেকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বেরিয়ে আসছে এবং রাস্তায় আন্দোলনকারীদের দিকে পাখির মতো গুলি ছুঁড়ছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ওই সময় পারভেজ গুলি থেকে বাঁচতে থানার ঠিক বিপরীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের একটি পিলারের নিচে লুকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
বৃষ্টি বলেন, ‘লাশ পাওয়ার পর, আমরা দেখেছি তার বুক অনেক রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল এবং দু’টি তাজা গুলিও করা হয়েছিল। একটি তার বাম কব্জিতে বিঁধেছিল এবং অন্যটি তার একই বাহুতে আঘাত করেছিল।’
বৃষ্টি জানান, তারা ঢামেক থেকে মুগদা হাসপাতালের বিছানার চাদরে ঢাকা পারভেজের লাশ গ্রহণ করেন। লাশ পাওয়ার পর পারভেজের হাতে ৫ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার দিকে মৃত্যু উল্লেখ করে একটি ব্যান্ড পাওয়া গেছে।
সূত্র : বাসস