২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

দুর্গাপূজা সাথে ইলিশ খাওয়ার কী সম্পর্ক?

কলকাতার বাজারে বাংলাদেশের ইলিশ - ছবি : বিবিসি

দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ভারতে ইলিশ মাছ পাঠানো নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পূজার মৌসুম এলেই বাংলাদেশ সরকার কয়েক হাজার টন পদ্মার ইলিশ রফতানি করে ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বাজারে ইলিশের চালান যায়।

এর আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমাদের দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ খেতে পারে তাই ভারতে ইলিশ রফতানি করা হবে না। পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসেছে।

কিন্তু দুর্গাপূজার সাথে সত্যিই কি ইলিশ মাছ, আরও বিশেষ করে পদ্মার ইলিশ খাওয়ার কোনও যোগ আছে?

এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, দুর্গাপূজার ধর্মীয় রীতিতে ইলিশ মাছ বা পদ্মার ইলিশ খাওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। পূজায় ইলিশ খাওয়ার রীতি হলো প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত একটা সংস্কৃতি। এটা এখন বাঙালিদের একাংশের কাছে হুজুগে পরিণত হয়েছে।

জানা যায়, পূজায় ইলিশ মাছ খাওয়ার হুজুগ সম্প্রতি শুরু হলেও গাঙ্গেয় বঙ্গদেশে ইলিশ মাছের কথা প্রাচীন সাহিত্যে ও পুরাণে অনেকবার উল্লেখ রয়েছে।

ইলিশ মাছ নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হয়েছে। ইলিশ পুরাণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মন লিখছেন, ‘ইল্লিশো মধুর, স্নিগ্ধো রোচনো, বহ্নিবর্জনঃ, পিত্তিকৃৎ কফকৃৎ, কিঞ্চিল্লঘু ধর্মোহ নিলাজহঃ’, যার মানে হলো ‘ইলিশ মাছ মধুর, স্নিগ্ধ, রোচক ও বলবর্দ্ধক, পিত্তকারি, কিঞ্চিৎ কফকারি, লঘু পুষ্টিকর ও বাতনাশক।

ইলিশ মাছ নিয়ে তিনি লিখেন, ‘ইলিশো খলিশশ্চৈব ভেটকিমর্দগুর এবচ, রোহিতো মৎসরাজেন্দ্রঃ পশ্চমৎস্যা নিরামিষাঃ’। সবচেয়ে ভালো পাঁচটি মাছের মধ্যে ইলিশও রয়েছে। যারা নিরামিষ খান তাদের ইলিশ মাছ খেতে কোনো অসুবিধা নেই।

আরেক জায়গায় ইলিশ নিয়ে আরো লিখেন, ‘পদ্মপুরাণে রান্নার বিভিন্নরকম বিবরণ আছে, তারকা তার নন্দাই লখিন্দরের জন্য যে রান্না করেছিলেন তাতে মাছ আর শাক দিয়ে রান্নার কথা, রোহিতের মুণ্ড দিয়া রান্ধে মুলাশাক, সরিষার শাক রান্ধে ইলিশার শিরে।’

গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন জানান, ‘এ লেখা থেকে বুঝা যায় বাঙালির রান্নায় ইলিশ মাছের প্রচলন অনেক যুগ আগে থেকেই। তবে এ ইলিশ মাছ খাওয়ার সাথে পূজার কোনো সম্পর্ক নেই।’

শরদিন্দু উদ্দীপন বলেন, আদিকাল থেকেই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষরা উৎসবকে কেন্দ্র করে ইলিশ মাছ খাওয়ার রীতি চালু ছিল। তিনি বলেন, ‘ইলিশ মাছের সাথে বাঙালির খাদ্য রীতির নিবিড় সংযোগ রয়েছে। ফলে এই সময়ে বঙ্গদেশে অধিকাংশ খাদ্য উৎসবে প্রাচীন কাল থেকে ইলিশের প্রচলন দেখা যায়। তার ধারাবাহিকতায় এখনো বিভিন্ন উৎসবে এ অঞ্চলের জন-জীবনে ইলিশের সংস্কৃতি টিকে রয়েছে।

গবেষক শরদিন্দু উদ্দীপন আরো বলেন, ‘কুড়মিদের করম উৎসব বা সাঁওতালদের কারাম উৎসবে যে নব-পত্রিকার প্রর্থনা করা হয়, শাকাম্ভরী দুর্গাপূজায়ও সে নব-পত্রিকার পূজা আমরা দেখি। পুরনো আমলের সে পূজার সাথে বর্তমান পূজার সম্পর্ক এখানেই। আবার গাসি পূজা, কুলোয় পূজা বা দক্ষিণ বঙ্গের আরেকটি বিখ্যাত পূজা, রান্না পূজাতেও ইলিশ ছিল আবশ্যক। ওই রান্না পূজাতে হাজার প্রকারের রান্না হলেও ইলিশ মাছ থাকতই।

তিনি বলছিলেন, দুর্গাপূজায় ইলিশ মাছ ভোগ দেয়ার যে প্রথা এখন দেখা যায়, তার কোনো পৌরাণিক ব্যাখ্যা নেই। এ প্রথা শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, কলকাতায় যখন রাজা নব কৃষ্ণ দেব দুর্গাপূজা শুরু করার পর থেকে। শুরুর দিকে দুর্গাপূজায় বৈভব প্রদর্শনের জন্যই ইলিশের প্রচলন শুরু হয়। এর আগে অবিভক্ত বঙ্গে ইলিশ মাছ লোক উৎসবের অংশ ছিল।

ইলিশ খাওয়ার সময়কাল

বাঙালি হোটেল রেস্তরাঁয় তো বটেই, অনেক পশ্চিমা কায়দার হোটেলেও দুর্গাপূজার স্পেশাল মেনুতে ইলিশের পদ থাকে। আবার পূর্ববঙ্গীয়দের বাড়িতে লক্ষ্মীপূজার দিনে জোড়া ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে।

সে দিনই ইলিশ খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় প্রজননের সময় শুরু হয় বলে, আবার জানুয়ারির শেষ বা ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পূজার দিনে ইলিশ খাওয়া শুরু হয়।

দুর্গাপূজার আচার-রীতির সঙ্গে ইলিশ মাছের কোনও যোগ না পাওয়া গেলেও নিম্ন-বঙ্গ অঞ্চলে যে বর্ষাকালের লোক-উৎসবগুলিতে ইলিশের প্রচলন ছিল, তা একাধিক গবেষক জানাচ্ছেন।

তারা আবার এটাও বলছেন পশ্চিমবঙ্গীয় এবং পূর্ববঙ্গীয় মানুষদের মধ্যে ইলিশ খাওয়ার সময়কালে ফারাক রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গীয়রা দুর্গাপূজার আগেই ইলিশ খাওয়া বন্ধ করে দেন, অন্যদিকে পূর্ববঙ্গীয়দের একাংশ দুর্গাপূজার পরে লক্ষ্মীপূজায় ইলিশ খেয়ে তার পরে ইতি টানেন।

খাদ্য-গবেষক-লেখক ও ফুড ভ্লগার সুরবেক বিশ্বাস বলছিলেন অবিভক্ত বাংলার দুই অঞ্চলের মানুষের ইলিশ খাওয়ার সময়কালের এই ফারাক।

“যারা খাঁটি পশ্চিমবঙ্গীয়, যাদের আমরা ঘটি বলে থাকি, এরকম বেশ কয়েকটি বনেদী পরিবারের কাছ থেকে আমি জেনেছি যে তারা বর্ষাকালের তিন-সাড়ে তিন মাস ইলিশ খান আর তা শেষ হয় রান্না পূজায় ইলিশ খাওয়ার মধ্যে দিয়ে,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

দক্ষিণবঙ্গের একটা বড় অঞ্চলে রান্না পূজার যে চল আছে, সেটা সাধারণত দুর্গাপূজার দিন ১৫ আগে পালন করা হয়। এইদিনেই বাঙালি হিন্দুদের একাংশ বিশ্বকর্মা পূজা করেন। বিশ্বকর্মাকে বাঙালি হিন্দুদের একাংশ কারিগরির দেবতা বলে মনে করেন।

“পশ্চিমবঙ্গীয় বনেদী পরিবারগুলি মনে করে যে রান্না পূজার পরে যে ইলিশ পাওয়া যায়, সেগুলো কোল্ড স্টোরেজ থেকে আসে। আবার পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে অনেকে আছেন যারা লক্ষ্মী পূজার দিনে জোড়া ইলিশ খেয়ে তারপরে সেবছরের জন্য ইলিশ পার্বণে ইতি টানেন,” জানাচ্ছিলেন সুরবেক বিশ্বাস।

তিনি আরও জানাচ্ছিলেন, “দুর্গাপূজায় পাঁঠা বলি হত, আবার যেসব বাড়িতে প্রাণীহত্যা করা হয় না, সেখানে চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। কিন্তু দেবীকে ইলিশ ভোগ দেওয়া হচ্ছে, এটা সচরাচর শোনা যেত না। ইলিশ একটা উৎসবকে চিহ্নিত করে, এটা পূজার নয়। এটা এখন একটা হুজুগ। শরৎকাল, আশ্বিন মাস তো ইলিশ খাওয়ার সময়ও নয়।“

পদ্মার ইলিশ না গঙ্গার ইলিশ?

দুর্গাপূজার আগে বাংলাদেশ থেকে ‘পদ্মার ইলিশ’ ভারতে রফতানি না হওয়া নিয়ে যারা সমাজ মাধ্যমে বিমর্ষ ভাব প্রকাশ করছেন, তাদের অতটাও মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন খাদ্য রসিক ও গবেষকরা।

ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মন তার বই ‘ইলিশ পুরাণ’-এ লিখেছেন, “আমরা গঙ্গার ইলিশ খেতে ভাল না পদ্মার ইলিশ ভাল তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করি। শুধু তাই নয় ঘটি আর বাঙালদের মধ্যে এ এক অন্যতম ঝগড়ার বিষয়। কমলকুমার মজুমদার ও রাধাপ্রসাদ গুপ্তর মতে গঙ্গার ইলিশ আর পদ্মার ইলিশের থেকে ভাল।

আবার সাহিত্যিক “বুদ্ধদেব গুহ একবার বলেছিলেন ঢাকা থেকে বন্ধুর পাঠানো ইলিশ খেয়ে কলম ঠিক মত ধরতেই পারছি না। ইমপোর্টেড পদ্মার ইলিশের তেলে কলম পিছলে যাচ্ছে। সুলেখক যতীন্দ্রমোহন দত্ত ইলিশ নিয়ে তাঁর লেখায় গঙ্গা আর পদ্মার ইলিশ নিয়ে এক ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। তা হল, ‘পুবদেশের মাছে তেল আর কলকাতার ইলিশে সুগন্ধ বেশি।

“এটাই মনে হয় অনেকটা সত্য,” লিখেছেন ইলিশ গবেষক দিগেন বর্মন।

আবার এক বর্ষীয়ান ‘মাছ-শিকারি’ যোগেন বর্মন, যিনি ষাট বছর ধরে মাছ ধরেন, তাকে উদ্ধৃত করে দিগেন বর্মন লিখেছেন, “গঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা ও বঙ্গোপসাগরে তিনি মাছ ধরেছেন। তার মতে গঙ্গার ইলিশের টেস্ট ভাল। গঙ্গার ইলিশের মতোই টেস্ট গোমতীর ইলিশে। ধলেশ্বরী নদীর ইলিশ আর ডায়মন্ডহারবারের (কলকাতার কাছে ভাগীরথী নদীর তীরের শহর) ইলিশ দেখতে ও খেতে প্রায় একই রকম। তাঁর মতে পদ্মার ইলিশ যদি মেঘনায় চলে যায় এবং কয়েকদিন থাকে তাহলেই তার টেস্টও অন্য রকম হয়ে যায়।“

খাদ্য গবেষক সুরবেক বিশ্বাস ভারত আর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইলিশের তুল্যমূল্য বিচার করতে গিয়ে বলছিলেন, “মাছের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে ইলিশ আর ইলিশের মধ্যে সেরা হল পদ্মার ইলিশ – এটা ধরে নেওয়া হয়। তবে আমি বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে শুনেছি এখন নাকি পদ্মার থেকেও মেঘনার ইলিশের স্বাদ বেশি ভাল। আবার পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি ধরা যায়, একটা সময়ে কোলাঘাটের ইলিশ বলে যেটা বাজারে পাওয়া যেত, রূপনারায়ণ নদীর ইলিশ, সেটা এখন প্রায় পাওয়াই যায় না। দূষণের কারণে মূলত এটা হয়েছে।

“গত কয়েক বছরে ভাগীরথীর মোহনার কাছাকাছি অঞ্চলের ইলিশ খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা বা লাগোয়া এলাকার বাজারে। সেটার স্বাদও খুব ভাল। আবার ওড়িশা থেকেও উচ্চাঙ্গের ইলিশ আসছে। আসলে আমাদের মাথায় একটা ধারণা গেঁথে গেছে যে পদ্মার ইলিশই সেরা,” বলছিলেন সুরবেক বিশ্বাস।

তাই পদ্মার ইলিশ না হলেও ভাল মানের, ভাল স্বাদের ইলিশের অভাব নেই পশ্চিমবঙ্গে, এমনটাই বলছেন গবেষকরা।

 


আরো সংবাদ



premium cement