গাজাকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন করার ট্রাম্পের প্রস্তাব যেসব দেশে সমালোচিত
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৯
![](https://www.dailynayadiganta.com/resources/img/article/202502/19690288_163.jpg)
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও বৈরীপক্ষ নির্বিশেষে সকলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র গাজা ভূখণ্ডের মালিকানা গ্রহণ করবে, ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে অন্যান্য দেশে চলে যেতে বাধ্য করা হবে এবং তারপর ভূমধ্যসাগর বরাবর এই অঞ্চলকে তার কথায় ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের এই পরামর্শ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী দ্রুত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, যার বেশিভাই ছিল এই ধারণার বিরোধী।
ব্রিটেন, চীন, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া ও স্পেন বলে যে তারা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করে যার অর্থ হচ্ছে গাজা ও ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন যার পাশেই থাকবে ইসরাইল।
এই দ্বি-রাষ্ট্র প্রস্তাবের লক্ষ্য হচ্ছে কয়েক দশক ধরে চলে আসা মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত ও যুদ্ধের অবসান ঘটানো। আর এটাই ওই অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির মূল দিক। যদিও নেতানিয়াহুর সরকার এর বিরোধী।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র, তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব দ্রুত ও কঠোর বিবৃতিতে বলেছে যে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য তাদের অবস্থান ‘দৃঢ়, অবিচলিত ও অপরিবর্তনশীল।’
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সমর্থনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান একই রয়েছে, যেমনটি ছিল আজ সকালে, যেমনটি ছিল গত বছর এবং ১০ বছর আগেও।’
নেতানিয়াহু এই পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে মঙ্গলবার বলেন, যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হামাস যাতে আর কখনো ইসরাইলের প্রতি হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে না পারে। নেতানিয়াহু এবার বললেন, ট্রাম্প একে (তার এই লক্ষ্যকে) নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয় এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হবে এবং এই চিন্তাধারা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া অবশ্যই লাভজনক হবে।’
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানকে তিনি সমর্থন করেন কি না, সে সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে ট্রাম্প কোনো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেননি। তিনি বলেন, গাজার বিষয়ে তার পরিকল্পনায় দ্বি-রাষ্ট্র কিংবা এক রাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্র এমন কোনো অর্থ বহন করে না।
ফিলিস্তিনি ও নিকটবর্তী দেশগুলো ট্রাম্পের ধারণা প্রত্যাখান করেছে।
ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসংঘের প্রতি ফিলিস্তিনি জনগণ এবং তাদের অবিচ্ছেদ্য অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে ট্রাম্প যা করতে চাইছেন তা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লংঘন।
হামাস বলছে, ট্রাম্পের এই গাজা প্রস্তাব হচ্ছে এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টির একটি উপায়। ইহুদিবাদীদের দখলকে গণহত্যা ও স্থানচ্যূত করার অপরাধের জন্য দায়বদ্ধ না করে, তাদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
গাজার মালিকানা গ্রহণের ব্যাপারে ট্রাম্পের আহ্বানের আগেই, সম্প্রতি মিসর ও জর্দান তার এই পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছে যে গাজার ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে তাদের দেশে স্থানান্তর করা হবে।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘ফিলিস্তিনিদের গাজা ভূখণ্ডের বাইরে স্থানান্তর না করেই’ গাজা পুনর্নির্মাণের ওপর জোর দিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভল্কার তুর্ক বুধবার বলেন, ইসরাইল অধিকৃত গাজা থেকে লোকজনকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া অবৈধ।
এক বিবৃতিতে তুর্ক বলেন, ‘যেমনটি আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত সম্প্রতি নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করেছে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূল নীতি এবং সকল রাষ্ট্রকেই এই অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। অধিকৃত অঞ্চল থেকে জনগণকে জোর করে স্থানান্তর কিংবা বহিষ্কার করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।’
তবে ট্রাম্প তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার এই ধারণাকে সমর্থন দেবেন জর্দানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাতাহ আল-সিসি এবং আশা প্রকাশ করেন যে ‘তারা তাদের হৃদয়কে উন্মুক্ত করবেন এবং আমাদের এমনই স্থান দেবেন যেখানে আমরা এটা সম্পন্ন করতে চাই এবং জনগণ শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করবে।’
দু’সপ্তাহ আগে দ্বিতীয় দফায় চার বছরের মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ট্রাম্পের গাজা প্রস্তাব ছিল মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিষয়ে তার প্রধান বিবৃতি।
ট্রাম্প বলেন, তার কল্পনায় রয়েছে ভূমধ্যসাগর তীরে একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র স্থাপন করা যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলেই মিলে-মিশে থাকবেন।
১৫ মাস-জুড়ে ইসরাইলি বোমায় ৪৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর বর্তমানে উপকুলীয় অঞ্চলের বেশিভাগই বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে, তারা ১৭ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।
তার সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা ভূখণ্ডের দায়িত্ব নেবে এবং সেখানে আমরা কাজ করব। আমরা এর মালিকানা গ্রহণ করব এবং সেখানকার বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা এবং অন্যান্য অস্ত্র-শস্ত্র আমরা বিনষ্ট করব। বিধ্বস্ত ভবনগুলো সরিয়ে ফেলব এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করব। যার ফলে অসংখ্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি যাদের সাথে কথা বলেছি, তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ থাকা, এর উন্নয়ন ঘটানো ও হাজার হাজার চাকরি তৈরির চিন্তাধারা পছন্দ করেছেন। তাদের মতে, এসব অসামান্য কার্যক্রমে ওই এলাকাটিও অসামান্য হয়ে উঠবে।’
ট্রাম্প অবশ্য এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাননি যে কিভাবে তিনি গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবেন। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি নাকচ করে দেননি।
তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন হলে, আমরা তা করব।’
গাজার মালিকানা গ্রহণের ব্যাপারে ট্রাম্পের ধারণা, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে তার আগেকার অবস্থান থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিক্রিয়া
গাজার ব্যাপারে ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন নেতাদের সাথে যুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বহু আইন প্রণেতা।
ডেলাওয়েরারের ডেমক্র্যাটিক সেনেটর ক্রিস কুন্স প্রেসিডেন্টের এই সব মন্তব্যকে আপত্তিকর ও পাগলামি এবং বিপজ্জনক ও বোকামি বলে অভিহিত করেন।
কুন্স বলেন, ‘এই ধারণা এ রকম ঝুঁকি তৈরি করছে যে বিশ্বের বাদ বাকি অংশ ভাববে যে আমরা ভারসাম্যহীন, আমরা বিশ্বাসযোগ্য অংশীজন নই কারণ আমাদের প্রেসিডেন্ট পাগলামি প্রস্তাব করছেন।’
মিশিগান কংগ্রেসের ফিলিস্তিনি মার্কিন সদস্য, প্রতিনিধি পরিষদের ডেমক্র্যাটিক সদস্য রাশিদা ত্লায়েব তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একটি পোস্টে ট্রাম্পকে তার গাজার সম্পুর্ণ জনগণকে অন্যত্র স্থানন্তরের ধারণাকে ‘খোলাখুলিভাবে জাতিগোষ্ঠীগত বিশুদ্ধিকরণের আহ্বান জানানোর জন্য’ অভিযুক্ত করেন।
তবে ট্রাম্প সমর্থক সাউথ ক্যারোলাইনার প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ন্যান্সি মেইস ট্রাম্পের অ্যাটলান্টিক পারের অবকাশ যাপনের স্থান ও দক্ষিণ ফ্লোরিডার ক্লাবের কথা উল্লেখ করে বিষয়টিকে হাল্কা ভাবে মূল্যায়ন করে বলেন, ‘আসুন আমরা গাজাকে মার-এ-লাগোতে রূপান্তরিত করি।’
প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন ট্রাম্পের গাজা গ্রহণের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ আমরা এর বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি তবে আমার মনে হয় এটা একটা ভালো অগ্রগতি।’
সেনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকান নেতা জন টুন নিরপেক্ষভাবে বলেন, ‘ট্রাম্প চাইছেন আরো শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ মধ্যপ্রাচ্য এবং সেখানকার জন্য কিছু ধারণা দিয়েছেন।’
সূত্র : ভিওএ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা