ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে গাজার নারীরা, শোনালেন যুদ্ধকালীন শোকের গল্প
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৩৯, আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:৩৪
গাজা উপত্যকার দেইর এল-বালাহর কাছে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে গাজা শহরে তার বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার সময় ইনশিরাহ দারাবেহের মনে কেবল একটি চিন্তাই ঘুরছে- তার মেয়ে মারামের লাশ খুঁজে বের করা এবং তাকে মর্যাদাপূর্ণভাবে দাফন করা।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাড়ি খুঁজতে ফিরে যাচ্ছি না। আমি শুধু আমার মেয়ের কবর খুঁজে বের করতে এবং তার নাম সমাধিফলকে লিখতে চাই।’
৫৫ বছর বয়সী ইনশিরাহকে ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে ১০ কিলোমিটার হেঁটে তার বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। তিনি মনে করেন বাড়ি ফিরতে তার কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে।
গত এক বছর ধরে যে আশ্রয়স্থলে তিনি ছিলেন তা অবশেষে ছেড়ে যাওয়ার সময় জানান, তার মধ্যে ভয়, বেদনা ও স্বস্তির মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে।
গাজায় ইসরাইলের নৃশংস যুদ্ধে ৪৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আরো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ধ্বংসস্তুপের মধ্যে নিখোঁজ রয়েছেন। নিহতদের বেশিভাগই নারী ও শিশু।
গত রোববার কার্যকর হওয়া ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তাবলী অনুসারে, যুদ্ধবিরতির সপ্তম দিনে অর্থাৎ এ সপ্তাহের শনিবার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলি সৈন্যদের পরিদর্শন ছাড়াই উত্তরে তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।
তবে শনিবার হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় বন্দী বিনিময়ের পর চুক্তি নিয়ে সাময়িকভাবে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ইসরাইল জানায়, আরবেল ইয়েহুদ নামে এক পণবন্দীর মুক্তির বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজায় ফিরে যেতে দেবে না।
সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন
ইসরাইলের স্থল আক্রমণের পর থেকে কেউ উত্তরে আর ফিরে যেতে পারেনি। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ অনুসারে, সামরিক অভিযান ও অবরোধের তীব্রতা বৃদ্ধির আগে উত্তর গাজা গভর্নরেটে ৬৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার মানুষ রয়ে গেছে বলে মনে করা হয়, যা সেখানকার যুদ্ধ-পূর্ব জনসংখ্যার ২০ শতাংশেরও কম।
চুক্তি অনুযায়ী গাজার দক্ষিণকে উত্তরের সাথে সংযুক্তকারী আল-রশিদ স্ট্রিট দিয়ে গাজাবাসীরা পায়ে হেঁটে ফিরে আসতে পারবে। তবে যানবাহন চলাচল নিয়ে বিতর্ক চলছে।
১৫ মাস ধরে অবিরাম ইসরাইলি বোমা হামলার ফলে গাজার ৯০ শতাংশ জনগণ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত এবং ৮০ শতাংশেরও বেশি ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এরপরেও ইনশিরার মতো বেঁচে থাকা গাজাবাসীরা হাল ছাড়তে প্রস্তুত নন।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকের সেই দুর্ভাগ্যজনক রোববারকে তার মনে হয় যেন গতকালের ঘটনা।
ইনশিরাহ বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম কয়েক সপ্তাহে আমি ও আমার স্বামী উত্তরে আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা আমার বড় নাতনিকে আমাদের সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তিন মেয়ে এবং তাদের স্বামীরা সেখানেই ছিল।’
২৭ অক্টোবর ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি পরের দিন পর্যন্তও জানতাম না যে মারাম শহীদ হয়েছে। যোগাযোগ পুনরুদ্ধার হওয়ার সাথে সাথেই আমার বড় মেয়ে আমাকে ফোন করে জানায়।’
মারামের বয়স ছিল ৩৫। অক্টোবরের শেষের দিকে গাজা সিটিতে ইসরাইলি বিমান হামলায় তার চার মাস বয়সী মেয়ে প্রথমে নিহত হয়। এ হামলার পরপরই মারামও নিহত হন।
আমার বাড়ির ধ্বংসস্তূপের উপরেই তাঁবু টানাতে চাই
ইনশিরাহর মতো হাজার হাজার নারীর সন্তান, স্বামী, বাবা ও ভাই হারানোর অবর্ণনীয় যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের যত্ন নেয়ার ভার বহন করছেন।
২৫ বছর বয়সী ওলফাত আবদ্রাব্বোর তিন সন্তান ছিল। এখন তার মাত্র দুটি সন্তান বেঁচে রয়েছে- ৬ বছর বয়সী মেয়ে আলমা এবং ১৮ মাস বয়সী ছেলে মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, ‘আমার চার বছরের সন্তান সালাহ, দেইর এল-বালাহে আমার কোলে মারা যায়। ২৭ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে ওলফাতের বাবা তাকে শুক্রবারের নামাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় ইসরাইল মসজিদে বিমান হামলা চালায়।’
ওলফাত বলেন, ‘আমি আমার নিজের সন্তানের কবর দেখিনি। আমার হৃদয় চিরে দু’ভাগ হয়ে গেছে। একবার আমার সন্তান শহীদ হলে এবং আমার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের সাথে আর আরেকবার আমার দুই সন্তানের সাথে, যারা কয়েক মাস আগে তাদের বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি শুধু চাই আমার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের উপর তাঁবু টানাতে এবং আমার পরিবারকে পুনরায় একত্রিত করতে।’
অবর্ণনীয় কষ্টের শরণার্থী জীবন
ওলফাত বা ইনশিরাহর মতো সন্তান না হারালেও জুলফা আবুশানাবের মতো অনেকেই তাঁবুর জীবনে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন।
দুই কন্যার মা ২৮ বছর বয়সী জুলফা ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে গাজা শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গাজার আত-তোয়াম এলাকা থেকে প্রথমে নুসাইরাত এবং তারপর মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি অন্য শরণার্থীদের সাথে এক বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। সেই অ্যাপার্টমেন্টে কেবল মেঝেতে গদিসহ শয়নকক্ষ রয়েছে - যার একটি পুরুষদের জন্য এবং অন্যটি মহিলা ও শিশুদের জন্য।
তিনি বলেন, ‘আমি আমার দুই মেয়েসহ অন্য দুই মহিলা ও তাদের চার সন্তানের সাথে একটি ছোট ঘরে থাকি। আমার স্বামী আলাদা ঘরে থাকেন।’
উত্তরে যারা এখনো রয়েছেন তাদের অনেকের কাছেই তিনি শুনেছেন ইসরাইলি ট্যাঙ্কের বোমাবর্ষণে তার বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এরপরেও একটি সাধারণ পরিবারের মতো জীবনযাপন করার জন্য তিনি তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুণছেন।
নিজ হাতে আমার ছেলের কবর দিতে চাই
উম মোহাম্মদ নামে পরিচিত ৬২ বছর বয়সী আট সন্তানের জননী জামালাত ওয়াদি যেখানেই ভ্রমণ করুক না কেন, তার এই যুদ্ধের ক্ষত কখনোই মুছে যাবে না।
উত্তরের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা উম মোহাম্মদ ২০২৩ সালের অক্টোবরে তার স্বামী ও সাত মেয়েকে নিয়ে দেইর-এল-বালাহে আশ্রয় নেন। তার ২৫ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ বাড়ি রক্ষা করার জন্য জাবালিয়ায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময় আমার ছেলে আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি আছে জানার পরেও সে উত্তরে ফিরে যাওয়ার জন্য জোর দেয়।’
তিনি জানান, তার ছেলে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর, তার এক বন্ধু নেটজারিম চেকপয়েন্ট দিয়ে মুক্তি পেয়ে ফিরে এসেছিলেন। সেই বন্ধু তাকে জানান, মোহাম্মদসহ আরো চার যুবককে চেকপয়েন্টে গুলি করা হয় এবং তার লাশ রাস্তায় ফেলে রাখা হয়।
সে ঘটনার পর এক বছর পার হয়েছে। এই এক বছরে ওম মোহাম্মদ তার ছেলের লাশের অবশিষ্টাংশ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। আল-আকসা হাসপাতালে লাশের আশায় অপেক্ষা করেছেন। তিনি মনে করেন, যদি তিনি তার ছেলের লাশ খুঁজে পান তাহলে তিনি তা শনাক্ত করতে পারবেন।
উম মোহাম্মদের কাছে উত্তর গাজায় ফিরে যাওয়ার কারণ এখন কেবল একটাই- তার ছেলের লাশ খুঁজে বের করা।
সূত্র : আল জাজিরা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা