কাতার সরকার ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে শান্তি চুক্তিতে কেন সফল হতে পারল না
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:১৩
কাতার সরকার ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেও তারা ওই প্রচেষ্টা স্থগিত করেছে। কারণ কোনোপক্ষই আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি।
কাতারে হামাসের কার্যালয় বন্ধ করার জন্য দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেও আছে বলে জানা গেছে।
ছোট এবং ধনী রাষ্ট্রটি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিপ্রণেতা হিসেবে নিজেদের একটি পরিচয় তৈরি করলেও বর্তমানে ইসরাইল-হামাস সঙ্ঘাতের মধ্যে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মধ্যস্থতা করা তাদের জন্যই কঠিন হয়ে পড়েছে।
কাতার কিভাবে মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠল
কাতার ১১ হাজার ৬০০ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত পারস্য উপসাগরের ছোট একটি দেশ। কিন্তু দেশটি বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করে এবং সেখানকার মাথাপিছু আয় বিশ্বের ষষ্ঠ-সর্বোচ্চ।
কাতার দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষকের ভূমিকা পালন করে আসছে। গত দুই দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে দেশটি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে আলোচনার আয়োজন করেছিল কাতার, যার মাধ্যমে ইসরাইলে বন্দি ২৪০ জন ফিলিস্তিনিকে এবং ফিলিস্তিনে বন্দি ১০৫ জন ইসরাইলি বন্দীকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
২০২০ সালে আফগানিস্তানে দুই দশকের দীর্ঘ যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তালেবান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তির মধ্যস্থতা করেছিল কাতার।
যার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা আফগানিস্তান থেকে নিজ নিজ বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় এবং তালেবান পুনরায় দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে বন্দি বিনিময় চুক্তিতেও কাতার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল।
একই বছর, চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া ইউক্রেনীয় শিশুদের ফিরিয়ে আনার জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল।
২০২০ সালে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ-এ সরকার এবং ৪০টি বিরোধী দলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করেছিল কাতার এবং ২০১০ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ দারফুরে সুদানের সরকার এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যেও তারা একটি শান্তি চুক্তির তত্ত্বাবধান করেছিল।
কাতার কেন শান্তি প্রতিষ্ঠার ভূমিকা আবির্ভূত হয়েছে
কাতার শান্তিরক্ষকের ভূমিকা পালন করবে এই বিষয়টি দেশটির সরকার তাদের সংবিধানে পর্যন্ত লিখে রেখেছে।
দেশটির সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘দেশের পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তি হলো আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করা।’
কাতার যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র তা নয়, দেশটি তালেবান এবং হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোকেও তাদের দেশে কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। যেখানে কিনা আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার সামরিক সদস্যকে আতিথ্য করছে তারা। যার কারণে দু’টি রাজনৈতিক পক্ষ- যারা একে অপরের সাথে সরাসরি কথা বলতে চায় না তাদের মধ্যে একটি সেতু হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হয়েছে দেশটি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের সদস্য এইচ এ হেলিয়ার তাই মনে করেন। তিনি বলেন, তালেবান এবং হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোর সাথে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে কাতার বেশ ভালো অবস্থানে আছে। কারণ, তারা কখনো তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির কারণে এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা দোহায় নিরাপদ বোধ করে। তারা মনে করে যে তারা নিরাপদে আলোচনা করতে পারবে, কেউ তাদের হত্যার চেষ্টা করবে না।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিকবিষয়ক থিংক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের ড. সানাম ভাকিল বলেছেন, ‘কাতার এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে যে তাদেরকে সবাই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখে, যারা সমস্যার সমাধান করে থাকে। কাতার শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করে। এর অর্থ হলো কাতার পশ্চিমাদের সাথে তাল মেলাতে পারে। এ কারণে আশেপাশের অঞ্চল আরো নিরাপদ এবং আরো স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।’
কাতারের কূটনীতিকদের একটি দল রয়েছে যারা শান্তি আলোচনা তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে উচ্চ প্রশিক্ষিত। তবে তারা যে সবসময় যুদ্ধরত পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি করতে বা স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে, সেটা বলা যাবে না।
ড. ভাকিল বলেন, ‘যখন কোনো সঙ্ঘাতের সমাপ্তি ঘনিয়ে আসে সহিংসতার চক্র ভাঙতে থাকে এবং দুই পক্ষ শান্তি প্রত্যাশা করে ওই পরিস্থিতি কাতারীরা খুব ভালোভাবে তত্ত্বাবধান করতে পারে।’
কেন ইসরাইল ও গাজার মধ্যে শান্তি স্থাপন করা কঠিন মনে করছে কাতার
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে তারা ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার প্রচেষ্টা স্থগিত করছে। তবে তারা দোহায় হামাসের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়ার খবরকে উড়িয়ে দিয়েছে।
ইসরাইলের সরকার তখন থেকে কাতারকে আক্রমণ করে বলেছে যে তারা হামাসকে সমর্থন করছে।
যাইহোক, ড. হেলিয়ার বলেছেন, ‘২০১২ সালে সিরিয়ার সরকারের সাথে হামাসের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর কাতারের সরকার হামাস নেতাদের দামেস্ক থেকে তাদের অফিস সরিয়ে দোহায় স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।’
তিনি বলেছেন যে ইসরাইল এবং হামাসকে পূর্ববর্তী সঙ্ঘর্ষের পরে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে সাহায্য করেছিল কাতার। কিন্তু তখন দুই পক্ষই স্থিতাবস্থায় ফিরে যেতে চেয়েছিল।
ড. ভাকিল বলেছেন, ‘এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ইসরাইলের সরকার যতোটা না শান্তি চায় তার চাইতে বেশি চায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তাদের এই উদ্দেশ্য অর্জনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই সাহায্য করবে। হামাস শুধু বেঁচে থাকার জন্য শান্তি চায়।’
হামাস কাতার ছেড়ে তুরস্ক বা ইরানে অফিস সরিয়ে নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ড. হেলিয়ারের মতে, কাতার হামাসের নেতাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এই কথা ভেবে তারা সেখানে থেকে যেতে পারে। যখন ইসমাইল হানিয়াহ দোহা ছেড়ে ইরানে যান, তখনই ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষে তাকে হত্যা করা সহজ হয়ে যায়।’
সূত্র : বিবিসি