সিঙ্গাপুরের জাহাজে বাংলাদেশী নাবিকের মৃত্যুর পর ২ বছর ধরে যে জটিলতা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১২ জুলাই ২০২৪, ১০:৩৫, আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ১০:৪১
সিঙ্গাপুরের জাহাজে বাংলাদেশী নাবিকের মৃত্যুর ঘটনা হত্যা মামলা হিসেবে তদন্ত হচ্ছে যেটিকে বিদেশী দেশটির নাগরিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা সুরাহার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
নাবিকের মৃত্যুর এই ঘটনায় প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা হলেও দুই বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এজাহারটিকে হত্যা মামলা হিসেবে তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়।
এই মামলাটি এখন তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।
আইনজীবীরা বলছেন, ‘প্রতি বছরই অসংখ্য বাংলাদেশী নাগরিক বিভিন্ন দেশে মারা যান। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলোর বিষয়ে সেভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাচ্ছে না। এই মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিদেশে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনার সুরাহার পথ তৈরি হবে।
যা ঘটেছিল এমটি কনসার্টো জাহাজে
বাংলাদেশী নাগরিক মো: আব্দুর রহমান ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী এমটি কনসার্টো জাহাজে নাবিক হিসেবে যোগ দেন। হক অ্যান্ড সন্স নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি ওই ট্যাঙ্কার জাহাজ নিয়োগ পান তিনি।
জাহাজটিতে থাকা ২৫ জনের মধ্যে একজন কোরিয়ান নাগরিক ছিলেন এবং বাকি ২৪ জন বাংলাদেশী ছিলেন।
যোগদানের কিছুদিন পরই পরিবারের সদস্যদের রহমান জানান, ‘জাহাজে কয়েকজন সহকর্মীর সাথে তার মনোমালিন্য হয়েছে। ঘটনাটি এক পর্যায়ে ঝগড়া ও হুমকির পর্যায়ে চলে যায়।’
পরিবারের পরামর্শে রহমান তখন জাহাজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেন। একইসাথে জাহাজ থেকে তাকে নামিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন।
পরিবারের সদস্যদের রহমান জানান, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন।
২০২২ সালের পহেলা জুন জাহাজটি থেকে ফোন করে তার (রহমান) পরিবারের সদস্যদের জানানো হয় যে তাকে অচেতন অবস্থায় ডেকে পাওয়া গেছে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তাকে পাওয়া গেছে এবং বিষাক্ত গ্যাসের কারণে তিনি মারা যেতে পারেন বলেও জানানো হয় তখন। ওই সময় জাহাজটি তাইওয়ানের জলসীমায় ছিল। চীনের একটি বন্দরে যাচ্ছিল এটি।
রহমানের ভাই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হালিমুর রশীদ বলেন, ‘ঘটনা জানার পর জাহাজের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন শামীম পারভেজের কাছে জানতে চাইলে বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মারা গেছে জানায়। ডিউটিরত অবস্থায় তাকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি বলে জানায়। কিন্তু সে যেখানে কাজে গেছে সেখানে ডিউটি অফিসারের আদেশেই গেছে।’
রশীদ দাবি করেন, ‘জাহাজ কর্তৃপক্ষ তার মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি করে। কারণ ডিউটিতে থাকলে কর্তৃপক্ষ জানার কথা সে কোথায় কিন্তু রহমানকে কর্তৃপক্ষ খোঁজাখুজি করার মিথ্যা কথা বলেছে বলে দাবি করেন তিনি।’
রশীদ আরো বলেন, ‘একবার বলছে মাথায় আঘাতজনিত কারণে, আরেকবার বলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছে, একেকবার একেক ধরনের কথা বলেছিলেন তারা।’
২০২২ সালের ৬ জুন জাহাজটি দক্ষিণ কোরিয়ার ইওসু বন্দরে পৌঁছে কোরিয়ান জাহাজ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির কাছে লাশটি হস্তান্তর করে।
পরে লাশটি স্থানীয় ইওসু চেননাম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে ময়নাতদন্ত করতে নিয়োগকারী অ্যাজেন্সিকে বলা হলেও ৪০ দিন পর ওই বছরের ১০ জুলাই লাশটি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ওই দিন বিমানবন্দর থানা লাশ গ্রহণ করে একটি অপমৃত্যুর মামলা করে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত করা হয়।
দুই বছরেও মামলা করা যায়নি কেন?
কিন্তু দুই বছরেও বিমানবন্দর থানা এর তদন্ত শেষ করতে না পারায় হাইকোর্টে রিট করেন ভুক্তভোগীর ভাই রশীদ। পরে গত জুন মাসে হাইকোর্ট বিমানবন্দর থানাকে রশীদের করা অভিযোগটিকে এজাহার হিসেবে গণ্য করে হত্যা মামলা হিসেবে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়।
জানা গেছে, এ মামলায় জাহাজে কর্মরত ছয়জনকে আসামি করা হয়।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘পুলিশের অনীহা, পরিবার চেষ্টা করছে দুই বছর ধরে। আইনানুযায়ী মামলা নেয়ার কথা থাকলেও দুই বছর ভিকটিমের পরিবারকে ঘুরিয়েও মামলা নেয় নাই পুলিশ।’
বড়ুয়া বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের জন্য আনইউজুয়েল ঘটনা। এর আগে, জাহাজে মৃত্যু কিংবা হত্যার ঘটনায় সরাসরি মামলার নজির নাই। পুলিশ হয়তো হেজিটেট ছিল বা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যও হতে পারে।’
ভিকটিমের ভাই জানান, ‘মামলাটি এখন তদন্তের জন্য বিমানবন্দর থানা থেকে সিটিটিসিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে।’
রশীদ বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় পর হাইকোর্টের আদেশে মামলা হয়। এয়ারপোর্ট থানা থেকে মামলাটি এখন সিটিটিসিতে তদন্তের জন্য ট্রান্সফার করা হয়েছে।’
সিটিটিসির তদন্ত কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, ‘গতকালই এ মামলা পেয়েছি। বাদীর সাথে কথা বলেছি। ডকুমেন্টস, পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো দেখেছি। কয়েকদিন পর মামলার পরিস্থিতি বোঝা যাবে।’
বাংলাদেশে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে
এ ঘটনা তদন্তে নৌ-পরিবহন অধিদফতরও তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কমিটির প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত ও সুপারিশে বলা হয়েছে, ময়নাতদন্তকারী বিশেষজ্ঞ সার্জনের মতে নাবিক আব্দুর রহমান শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছেন এবং মৃত্যুর আগে তার গায়ে আঘাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এছাড়া কেমিকেল অ্যানালাইসিস রিপোর্টে যেহেতু কোনো বিষের প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাই আব্দুর রহমান কিভাবে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেলো তা সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স (পারিপার্শ্বিক প্রমাণ) এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে মতামত দিয়েছে সেই কমিটি।
এতে আরো বলা হয়েছে, রহমানের মৃত্যু কমিটির কাছে রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার জন্য দুর্ঘটনার রাতে জাহাজের ভয়েস ডাটা রেকর্ডার এবং সে রাতের সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করা জরুরি।
মৃত্যুর আগে ইনজুরির যে ইঙ্গিত রয়েছে তা তদন্তের জন্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নয়। বরং এমন তদন্ত ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশনের আওতাভুক্ত বলে কমিটি মনে করে। বাংলাদেশ পুলিশের প্রশিক্ষিত তদন্তকারী সংস্থার মাধ্যমে পুনঃতদন্ত করাতে সুপারিশ করে কমিটি।
এছাড়া জাহাজে দুর্ঘটনার সময় কর্মরত ডেক ডিপার্টমেন্টের কতিপয় অফিসারের দায়িত্ব পালনে অদক্ষতা, অবহেলা এবং অপেশাদারিতাসুলভ আচরণের প্রমাণ পেয়েছে কমিটি।
তিনজন নাবিকের নাম উল্লেখ করে কমিটি বলেছে, বিদেশী পতাকাবাহী জাহাজে এমন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নাবিকদের ইমেজ সঙ্কট তৈরি হতে পারে এবং নাবিকদের চাকুরির বাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এক্ষেত্রে জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মো: মোকাররম হোসেন, চিফ অফিসার মো: তরিকুল আলম ভুঞা এবং সেকেন্ড অফিসার ফয়সালের ওয়েল অ্যান্ড কেমিকেল ট্যাঙ্কার এনডোর্সমেন্ট বাতিল করাসহ তাদের সনদ ও সিডিসি সাময়িকভাবে স্থগিত করার জন্য সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি।
যা বলা হয়েছে কোরিয়ার তদন্তে
কোরিয়া স্ট্যান্ডার্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসেস যে তদন্ত করেছে তাতে বলা হয়েছে, বিষাক্ত গ্যাসের বিষক্রিয়ায় আব্দুর রহমানের মৃত্যু হয়েছে। একইসাথে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত করার কথা বলা হয়েছে এতে।
জাহাজটির মাস্টার অফিসের সাথে আলোচনার পর তারা পহেলা জুনের রাত ১১টায় রহমানের মৃত্যু হয়েছে বলে ঘোষণা দেয়।
এরপর অফিসের নির্দেশ মোতাবেক ২ জুন ‘কনসার্টো’ সফর সংক্ষিপ্ত করে কোরিয়ার ইওসু বন্দরের দিকে রওনা দেয় এবং ৫ জুন জাহাজটি ওই বন্দরে পৌঁছায়।
যা বলছে নাবিকদের নিয়োগকারী অ্যাজেন্সি
বাংলাদেশ থেকে এই জাহাজটিতে নাবিক নিয়োগ দিয়েছিল হক অ্যান্ড সন্স নামে সরকার অনুমোদিত একটি কোম্পানি।
বিমানবন্দর থানায় অপমৃত্যুর মামলার পর এই কোম্পানির কাছে জাহাজের ওই দিনের সিসিটিভি ফুটেজ, কন্ট্রোল রুমের ভয়েস রেকর্ড এবং ডিউটি রেজিস্টার চাওয়া হয়।
কোম্পানিটি এসব নথি এবং রেকর্ড তাদের কাছে নেই বলে জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তারা জানিয়েছে, জাহাজটি সিঙ্গাপুরের নিবন্ধিত জাহাজ এবং ঘটনার সময় এটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সিঙ্গাপুর সরকারের তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার তদন্ত করছে। তাদের কাছে নথি এবং রেকর্ড রয়েছে। তারা এই নথি তাদের কাছ থেকে নিতে পারছে না বলে পুলিশকে জানানো হয়েছে।
একইসাথে এসব নথি পাওযার জন্য সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে বলে প্রতিষ্ঠানটি।
হক অ্যান্ড সন্সের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মহিউদ্দিন কাদেরী বলেন, ‘এটা একটা কেমিকেল ট্যাঙ্কার। কেমিকেল ট্যাঙ্কারে কার্গোর হ্যাজার্ড থাকে। আমরা যতদূর জানি কার্গো ইনহেল করেই সম্ভবত তার মৃত্যু হয়েছে।’
কাদেরী বলেন, ‘এটা নিয়ে ইনভেস্টিগেশন হইছে। সিঙ্গাপুর অথরিটি ইনভেস্টিগেশন করেছে, শিপ ওউনার করছে, ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং ইনভেস্টিগেট করছে। ওকে মেরে ফেলা হইছে এরকম কেউ বলেনি। কেমিকেল ট্যাঙ্কারের জব হাজার্ডাস জব। এটা নিয়ে তারা যা করছে এটা ঠিক না।’
তবে, বাংলাদেশে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্তে শ্বাসরোধে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেমিক্যাল ইনহেল করলে যখন আর অক্সিজেন পাবে না তখন মনে হবে যে এটা শ্বাসরোধে মৃত্যু।’
বিদেশে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর বিচার আইনজীবীরা বলছেন, ভিকটিম এবং অভিযুক্ত সবাই বাংলাদেশী ফলে অন্য দেশের জলসীমানায় এবং অন্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজে ঘটনাটি ঘটলেও বাংলাদেশে বিচার করতে কোনো বাধা নেই।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী বাংলাদেশী নাগরিক পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অপরাধ করলেও বাংলাদেশেই এর বিচার সম্ভব বলে জানান তারা।
বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে এর বিচার করা যাবে। এটা জাহাজে হলো না এয়ারক্রাফটে হলো এটা নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। যারা অভিযুক্ত তারাও বাংলাদেশী। তারাও বাংলাদেশে থাকে। ফলে বাংলাদেশেই বিচার করতে বাধা নেই।’
তিনি বলছেন, বিভিন্ন দেশে অসংখ্য বাংলাদেশী নাগরিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসে। এসব মৃত্যুর কোনো ফয়সালা হয় না।
বড়ুয়া বলেন, ‘এ মামলার একটা জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রেটেশন যদি আসে তবে যেটা হবে, বাংলাদেশে এমন মৃত্যুর ঘটনা আরো ঘটেছে কিন্তু মামলা হয়নি, সেই জায়গাটা কমপক্ষে উত্তরণ করা সম্ভব। ভবিষ্যতে তবে মানুষ বিচার পাবে।’
বড়ুয়া মনে করছেন, এ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হলে বিদেশে যেসব অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় সেসব ঘটনার বিচার শুরুর পথ তৈরি হবে।
‘এই মামলাটা যখন আসলো তখন মনে হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কোথাও না কোথাও কথা বলার একটা জায়গা হলেও থাকতে হবে। এটা দিয়ে যদি কথা বলার একটা এভিনিউ ওপেন করা যায়, অন্তত রাস্তাটা যদি তৈরি হয়,’ আশাবাদ এই আইনজীবীর।
সূত্র : বিবিসি