২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

রাফাহতে ভয়াবহ সংঘর্ষে ইসরাইলি ৪ সেনা নিহত

-

- ইসরাইলি দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব বিবেচনা জাতিসঙ্ঘের
- দশম বারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফরে ব্লিনকেন
- ইসরাইলি হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে ভয়াবহ সংঘর্ষে ইসরাইলের চার সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। নিহতরা হলেন- ক্যাপ্টেন ড্যানিয়েল মিমন তোফ, স্টাফ সার্জেন্ট আগম নাইম, স্টাফ সার্জেন্ট অমিত বাকরি এবং স্টাফ সার্জেন্ট দোতান শিমন। নিহতদের বয়স ২১ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে।
টাইমস অব ইসরাইল জানায়, নিহতদের মধ্যে মিমন তোফ ছিলেন ডেপুটি কোম্পানি কমান্ডার। এছাড়া নাইম হলেন ইসরাইলের প্রথম নারী সৈনিক, যিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযানে নিহত হলেন। এসব সেনার মৃত্যুতে গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে স্থল আগ্রাসন চালাতে গিয়ে ইসরাইলের হিসাব মতে, নিহত সেনার সংখ্যা ৩৪৮-এ দাঁড়াল। মঙ্গলবারের সংঘর্ষে যে কোম্পানির চার সেনা নিহত হয়েছেন, ওই কোম্পানিরই এক অফিসার ও দুই সৈনিক গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এদিকে রাফায় আরপিজি ফায়ারে গিভাতি ব্রিগেডের নজরদারি ইউনিটের এক অফিসার গুরুতর আহত হয়েছেন। এ ঘটনার তথ্যও ইসরাইলি বাহিনী নিশ্চিত করেছে।

ইসরাইলি হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত : এদিকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৪১ হাজার ২৫০ জনে। এছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৯৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। এই তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু।
খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় আরো ২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪১ হাজার ২৫২ জনে পৌঁছেছে বলে মঙ্গলবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরলস এই হামলায় আরো অন্তত ৯৫ হাজার ৪৯৭ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন। মন্ত্রণালয় বলেছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত আগ্রাসনে ২৬ জন নিহত এবং আরো ৮৪ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ মনে করছে, গাজা উপত্যকাজুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।

মিসরে পৌছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : গতকাল বুধবার মিসরে পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে একটি চুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চলমান প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ব্লিনকেন কায়রো গেলেন। ১১ মাসের বেশি সময় ধরে গাজা যুদ্ধ চলছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে মিসর, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যস্থতাকারীরা অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবে তা এখনো অধরা রয়ে গেছে।
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ প্রায় এক বছর হতে চলেছে। আগামী মাসের ৭ তারিখে এই যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হবে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত বলেছেন, লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা ম্লান হয়ে আসছে। তবে বড় পরিসরে আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের আশঙ্কা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। এর আগে, গ্যালান্ত গত সপ্তাহে হামাসের উদ্দেশে বলেছিলেন, গাজায় সামরিক কাঠামোয় হামাসের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
তবে ইয়েমেনের হাউছি বিদ্রোহীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে হামাসপ্রধান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, গাজায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ১১ মাসের বেশি চলা যুদ্ধ শেষে শত্রুপক্ষের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা ভেঙে দেবে। সিনওয়ার বলেন, ‘আপনাদের (হাউছি) এবং লেবানন ও ইরাকের গোষ্ঠীগুলোর সাথে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই শত্রুকে বিনাশ করবে এবং তাদের পরাজয় নিশ্চিত করবে।’
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে একটি চুক্তি সইয়ের লক্ষ্যে কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসর। এ চুক্তির উদ্দেশ্য, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বন্ধের পাশাপাশি ইসরাইলি বন্দী ও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করা।

দখলদারিত্ব বন্ধের প্রস্তাব : গাজা ও অধিকৃত পশ্চিমতীরে আগামী এক বছরের মধ্যে ইসরাইলের ‘অবৈধ উপস্থিতি’ বন্ধ এবং দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও অস্ত্র সরবরাহে নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব দিয়েছে ফিলিস্তিন। এই প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় বুধবার এই প্রস্তাব ১৯৩ সদস্যের অ্যাসেম্বলিতে ভোটের জন্য উত্থাপন করার কথা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার প্রথম বার্ষিকী নিকটে আসতে থাকায় এবং পশ্চিমতীরে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় গুরুত্ব দিচ্ছে জাতিসঙ্ঘ।
তবে সদস্য দেশগুলোকে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়ে জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেছেন, এই প্রস্তাব এ অঞ্চলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না বরং পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। শান্তি ও অগ্রগতির আশাকে বিলম্বিত করবে। সাধারণ পরিষদে গৃহীত হলেও প্রস্তাবটি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হবে না। তবে এর সমর্থন বিশ্ববাসী কী চায় সেই জনমত প্রকাশ করবে। ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদের মতো এই পরিষদে কোনো ভেটো নেই। এর আগে গত জুলাইয়ে জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ আদালত এক রায়ে বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরাইলের উপস্থিতি অবৈধ এবং অবশ্যই এর অবসান ঘটাতে হবে।

১৯৬৭ সালে যুদ্ধের সময় দখল করা জমির ওপর ইসরাইলের শাসনের ব্যাপক নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত বলেন, এই এলাকাগুলোর ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্বের কোনো অধিকার নেই। বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনিরা ‘অস্তিত্বের হুমকির’ মুখোমুখি উল্লেখ করে সাধারণ পরিষদের বৈঠকের শুরুতে জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর বলেন, ইসরাইল তাদের ‘শেকলে’ বদ্ধ করে রেখেছে। ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের ‘মর্যাদা, শান্তি ও নিরাপত্তার’ সাথে নিজেদের পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, ‘যারা মনে করে ফিলিস্তিনি জনগণ দাসত্বের জীবন, বর্ণবাদের জীবন মেনে নেবে, তারাই বাস্তববাদী নয়। ফিলিস্তিন সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান ছাড়া আমাদের অঞ্চলে শান্তি সম্ভব বলে যারা দাবি করে, তারা বাস্তববাদী নয়।’ প্রস্তাবে ইসরাইলকে তার সেনা প্রত্যাহার, অবিলম্বে নতুন সব বসতি নির্মাণ বন্ধ এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে সব বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়াও ইসরাইলকে তার দখলদারিত্বের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির জন্য ফিলিস্তিনিদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথাও বলা হয়েছে।

ইসরাইলের সাথে সম্পৃক্ত বাণিজ্য বা বিনিয়োগ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে এবং ‘বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতাসহ’ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবটি প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস বলেন, প্রস্তাবে বেশকিছু অসঙ্গতি রয়েছে। এটি আইসিজের নিয়মনীতির সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। এছাড়াও গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন’ এবং ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের বিষয়টি এই প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, ‘এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য বাস্তব সুফল বয়ে আনবে না বলে আমরা মনে করছি। এটি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। সঙ্ঘাত অবসানে যেসব চেষ্টা চলছে সেগুলো জটিল করে তুলতে পারে। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলোকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আমি মনে করি।’ রিয়াদ মনসুর বলেন, প্রাথমিক খসড়ায় ছয় মাসের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্বের অবসান ঘটানোর দাবি জানানো হলেও কিছু দেশের উদ্বেগের কারণে সময় বাড়িয়ে এক বছরের কথা বলা হয়েছে। মনসুর আরো বলেন, এই প্রস্তাবটির লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় পাওয়া যদিও তা আইনত বাধ্যতামূলক নয়। ইসরাইল এই প্রস্তাবে গুরুত্ব নাও দিতে পারে মনে করছেন মনসুর। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিরা তখন আরেকটি প্রস্তাব জমা দেবে।


আরো সংবাদ



premium cement