বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে গুলি
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কঠোর শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত মো: রুবেল (৩২) আর কখনো গায়ে-গতরে খেটে রোজগার করতে পারবেন না। কারণ আন্দোলনে পুলিশের গুলি তার বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। রুবেল শুকরিয়া আদায় করেন বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে গুলি বেরিয়ে গেলেও ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গের ক্ষতি হয়নি। রুবেল স’ মিলের একজন শ্রমিক। ছিলেন মেদহীন হালকা-পাতলা একজন যুবক। সকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে যেতে পারতেন। কিন্তু গত ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে শরীরের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। নিজের শরীরটা এদিক-ওদিক নাড়ানোর ক্ষমতাও এখন নেই। শারীরিক পরিশ্রম করে ভবিষ্যতে আর খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন আর কখনো শারীরিক পরিশ্রম করা যাবে না। শারীরিক পরিশ্রম করতে না পারলে সংসার কীভাবে চলবে ? কথাগুলো বলতে বলতে চোখে পানি এসে গেল রুবেলের। রুবেল ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটের পুরনো ভবনের ৫০২ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রুবেল বলেন, ‘গুলি খাওয়ার পর কীভাবে হাসপাতালে আসলাম বলতে পারব না, শুনেছি আন্দোলনকারীদের কেউ নাকি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। গুলিটা লাগার সাথে সাথে টের পাইনি। আমার বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে গুলি বের হয়ে আমার পেছনে যে লোকটা ছিল তার বুকে গুলি লাগলে সে যে মাগো মাগো বলে চিৎকার করেছে সেটা শুনতে পেয়েছিলাম কিন্তু এরপর আর কিছু মনে নেই।
রুবেল বলেন, ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ৩টার দিকে হাসিনার পতন হয়েছে, হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে খবর পাওয়ার পর আনন্দে বাসায় ফিরছিলাম। কল্যাণপুরে তখনো রাস্তায় পুলিশ ছিল। পুলিশের সাথে ছিল আওয়ামী লীগের গুন্ডারাও। ওদের রাস্তা থেকে তাড়িয়ে দিতেই নেমেছিলাম। হঠাৎ শুনি হাসিনা ‘পালিয়েছে’ সেই আনন্দে আর রাস্তায় থাকতে চাইনি। বাসায় যেতে চাচ্ছিলাম। বাসায় আবার বাবা, স্ত্রী অপেক্ষা করছিল, তাদের উদ্বেগও ছিল। আমি ভালো আছি এ খবরটি জানাতে এবং তাদের উদ্বেগ দূর করতে বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। সে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি, গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। আমার আপনজনদের উদ্বেগ আমি কমাতে পারিনি। তারা এখনো উদ্বেগের মধ্যেই আছেন। তারা এখন আরো উদ্বিগ্ন এ জন্য যে, ভবিষ্যতে আমার কী হবে, সংসার কীভাবে চলবে এ ভেবে। রুবেল বলেন, আমার ছোট দুইটা বাচ্চা আছে, সাথে আমার বাবাও থাকেন। দুই বাচ্চার পেছনে খরচ আছে, আমার বাবার পেছনে খরচ আছে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন, তার ওষুধ লাগে, এ বয়সে বিশেষ যত্ন লাগে। কীভাবে যে কী করব তা ভেবে ভেবে রাতে ঘুম হয় না।
কেন আন্দোলনে গিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে রুবেল বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই শেখ হাসিনা নামক ওই মহিলার তামাশা দেখে আসছি। টেলিভিশনে কথা বললে, সত্য কথা কম বলত। আমি পড়াশোনা করিনি, তবু আমার মতো অনেকের চোখেই ধরা পড়তো এ মহিলা অসত্য কথা বলছে, তার অভিনয় ভালো লাগতো না। জিনিস-পত্রের দাম এতো চড়েছে যে পেট ভরে খেতে পারিনি। বাজার করতে গেলে এখন আর ব্যাগ ভরে বাজার করতে পারি না। রুবেল জানান, ‘আন্দোলনে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল, ভোটার হওয়ার পর থেকে একবারও ভোট দিতে পারিনি। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অত্যাচারে কেউ কথা বলতে পারত না, পুলিশের ধরে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে আমার মতো সাধারণ মানুষও ভুগতাম। দেশে কোনো বিচার ছিল না। এবার সুযোগ পেয়ে অন্যান্যের সাথে আন্দোলনে নেমেছি। পরে কী হবে মনে করিনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নেমেছে, তাদের সাথে আমরাও নেমে যাই। তখন বাবা, বউ অথবা মেয়েদের কথা মনে পড়েনি। আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে এখন এসব কথা ভাবি, তবে আন্দোলনে গিয়ে একটা অত্যাচারীকে তাড়াতে পেরেছি এতেই গর্ব বোধ হয়।
রুবেল জানান, ভবিষ্যতে কী করব জানি না। তবে একটা কিছু করতে হবে। ভোলার লালমোহনের ইলিশাকান্দী গ্রামের বাড়িতে কিছুই নেই, বসত-ভিটাও নেই। সেখানেও যেতে পারব না। তবে একটা কিছু করতে হবে। রুবেল বলেন, কল্যাণপুরের লালন স’মিলে কাজ করলেও খবর দেয়ার পর স’মিলের মালিক একবারও খবর নেয়নি। আমি বকেয়া টাকাও পাই তার কাছে।
কী করতে চান, জিজ্ঞাসা করলে রুবেল জানান, কেউ যদি কিছু টাকা দেন, স্ত্রীর সহযোগিতায় ছোট ব্যবসা গড়ে তুলতে পারব। রাস্তায় ঝাল-মুড়ি বিক্রি করতে পারব। সেজন্য কিছু পুঁজি লাগবে। রুবেল মনেপ্রাণে চাচ্ছেন, তার এ অসহায় সময়ে কেউ তাকে যেন কিছু পুঁজি দিয়ে সহযোগিতা করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা