২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ৭ ক্ষতির মুখে দেশ

-


জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম বড় সাত ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, অম্লতা, চরম উষ্ণতা, তীব্র শীত, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীতে বন্যার প্রভাব অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা এর প্রভার তুলে ধরে বলছেন, গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে বর্ষাকালেও চলা তাপপ্রবাহ এসব কিছু যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে, তেমনি গ্রীষ্মকালের তীব্র গরমের সময়ও পরিবর্তিত হয়ে তা বর্ষাকাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। এভাবে করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান-ন্যাপ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও অম্লতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব আছে। এর ফলে সমুদ্রের ইকো-সিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে এবং সামুদ্রিক বিভিন্ন মাছের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন স্বল্পতাও তৈরি করতে পারে।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে জানিয়ে এতে বলা হয়, বাংলাদেশ উপকূলের কাছাকাছি এলাকায় প্রতি বছর বর্ষাকালের আগে যেখানে শূন্য দশমিক শূন্য এক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে যেত এখন বর্ষাকালে সেই তাপমাত্রা থাকে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ আট ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তবে শীতকালে সেটি কমে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য চার ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় এবং বর্ষা-পরবর্তী সময়ে সেটি হয় শূন্য দশমিক শূন্য দুই এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ অবস্থায় নিকটবর্তী সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বাড়তে বাড়তে এক থেকে এক দশমিক চার ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে।

অন্য দিকে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক সাংবাদিকদের জানান, দেশে বছরের উষ্ণতম দিনের সংখ্যা এখন শুধু এপ্রিল মাস তথা গ্রীষ্মকালে সীমাবদ্ধ নেই। বর্ষাকালেও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মতে, আগে বাংলাদেশে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত তাপপ্রবাহ দেখা যেত। কিন্তু গত বছর সেই তাপপ্রবাহ সেপ্টেম্বরে গিয়ে ঠেকেছে।
ওয়ার্ল্ড ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ১০-এ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝুঁকিগুলোর তীব্রতা বাড়ছে বলেই আবহাওয়ার প্যাটার্ন তথা ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা আগের তিন দশকের চেয়ে তীব্রভাবে বাড়ছে; অর্থাৎ ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের তাপমাত্রা তুলনামূলক কম ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে এটি ক্রমেই বাড়ছেই। এমনকি গত ৩০ বছর ধরে শীতকাল ও বর্ষাকালেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম পড়ছে।

‘জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা’ (ন্যাপ)-এর তথ্যানুযায়ী, দেশে শীতকাল অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ও বর্ষা-পূর্ববর্তী মার্চ থেকে মে এ সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। কিন্তু বর্ষার সময় জুন থেকে সেপ্টেম্বর ও বর্ষা পরবর্তী অক্টোবর থেকে নভেম্বর সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়ছে। এসব কারণে শীতকালে অনেক বেশি শুষ্ক এবং বর্ষাকালে অনেক বেশি ভেজা আবহাওয়া থাকছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ৩০ সাল নাগাদ ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হবে এবং পশ্চিমাঞ্চলে এই পরিমাণ কমতে থাকবে। কিন্তু ২০৫০ সালে সারা দেশেই বৃষ্টিপাত বাড়বে।
অন্য দিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দেশে গত ৩০ বছর ধরে উপকূলবর্তী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্য দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ বেড়ে গিয়ে প্রায় প্রতি বছরই দেশে বন্যা দেখা দিচ্ছে। আর দীর্ঘ সময় ধরে চলা শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়। এর বাইরে গত ৪৩ বছরে শীতের ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে ডিসেম্বরের আগে থেকেই ঢাকায় শীত পড়ত। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালের শীত মৌসুমে মধ্য ডিসেম্বরেও ঢাকায় শীত অনুভূত হয়নি।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, গবেষণা অনুযায়ী আগে ঢাকায় জানুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ হতো। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকেই জানুয়ারি মাসে ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহের পরিমাণ কমে গেছে। আবার জানুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ হলেও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামছে না। অথচ মানুষের শীত শীত অনুভূতি বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীভাঙন, আকস্মিক বন্যা, শহরাঞ্চলের বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, তীব্র তাপপ্রবাহ, বজ্রপাত ও ভূমিধসের মতো ক্ষতিকর সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।

 


আরো সংবাদ



premium cement