মূল কারণ নিয়ে ধোঁয়াশায় ডিবি
রিমান্ডে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০৫
ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিলিং মিশনে জড়িত সাতজনের সবাইকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তবে আনার হত্যায় কারা লাভবান হয়েছে, হত্যার মূল মোটিভ কী, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে এখনো বলতে পারছে না সংস্থাটি।
ডিবি পুলিশ বলছে, আজিম হত্যায় কারা আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, তা বের করতে কাজ চলছে। হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য সব কারণ আমলে নিয়ে মোটিভ উদঘাটনে তদন্ত চলছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, যখনই আমাদের কাছে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যা ঘটনার খবর আসে, তখনই আমরা মাস্টারমাইন্ড শিমুল ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করেছি। এরপর তানভীর ও সিলাস্তিকে গ্রেফতার করি। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। এরপর আমরা নিজেরা কলকাতায় গিয়ে সঞ্জিভা গার্ডেন পরিদর্শন করি। এই হত্যাকাণ্ডে আরো দু’জন জড়িত ফয়সাল ভূঁইয়া ও মোস্তাফিজুর রহমানের নাম জানতে পারি। তারা আত্মগোপনের জন্য ফটিকছড়ি ও সীতাকুণ্ডের মাঝখানে পাতাল কালীমন্দিরে লাল ধূতি পরে অবস্থান করছিল। সেখানে নিজেদের হিন্দু পরিচয় দিয়ে বাঁচার জন্য লুকিয়েছিল।
হারুন অর রশীদ বলেন, এই দু’জনকে গ্রেফতারের জন্য আমাদের একটি টিম ছিল ঝিনাইদহে, আরেকটি টিম সুন্দরবনে গিয়েছিল। অন্য দু’টি টিম খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ডে কাজ করছিল অনেক দিন ধরে। সব দিকে গোয়েন্দা জাল বিছিয়ে বুধবার সেই দু’জনকে গ্রেফতার করেছি।
ডিবি প্রধান জানান, ১৩ মে সকালে এমপি আনার তার বন্ধু গোপালের বাসা থেকে বের হন। কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে অপেক্ষায় ছিল ফয়সাল। সে আনারকে রিসিভ করে লাল গাড়ির কাছে যায়। সেখানে অপেক্ষায় ছিল শিমুল ভূঁইয়া। আর অপর দিকে সঞ্জিভা গার্ডেনের ভাড়া বাসায় অপেক্ষায় ছিল মোস্তাফিজ ও জিহাদ হাওলাদার। ফয়সাল, শিমুল ভূঁইয়া আনারকে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলে তাকে রিসিভ করে শিলাস্তি রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান। পরে তারা নিচে কর্নারের রুমে যায়। আনার যখন বুঝতে পারেন তিন-চারজনের গতিবিধি, তখন তিনি অনেক কাকুতি-মিনতি করেন, বাঁচার চেষ্টা করেন। দৌড় দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টার সময় ফয়সাল তার নাকে-মুখে ক্লোরোফর্ম ধরে নিস্তেজ করে। এরপর তাকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আনার কিলিং মিশনে সাতজন অংশ নিয়েছে। তারা সাতজনই গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল, মোস্তাফিজুর, ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার জিহাদ হাওলাদার, আমাদের তথ্যের ভিত্তিতে নেপালে আত্মগোপনে থাকা সিয়ামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া তানভীর ও সিলাস্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এর বাইরে আরো দু’জন আমাদের কাছে গ্রেফতার রয়েছেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু ও গ্যাস বাবু। ঢাকার ডিবির হাতে গ্রেফতার পাঁচজনের মধ্যে চারজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে।
আখতারুজ্জামান শাহীনের বিষয়ে হারুন বলেন, শাহীন মাস্টারমাইন্ড ছিল ও আছে। তিনি তদন্ত থেকে শেষ হয়ে যাননি। কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত সাতজনই গ্রেফতার হয়েছে। এর বাইরে মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী, মোটিভ, অর্থদাতা এগুলো তো অন্য বিষয়। এখনো আমাদের কাছে শাহীন মাস্টারমাইন্ড। কারণ সে তার পাসপোর্ট দিয়ে কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিল। হত্যার পরিকল্পনা, বাসা ভাড়া, এসবই তো শাহীন করেছে। শাহীন ১০ মে কলকাতা থেকে দেশে আসে। জিহাদ বাদে হত্যার পর একে একে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সবাই দেশে আসে, কেউ নেপালে চলে যায়। শিমুল ভূঁইয়া গ্রেফতারের পর শাহীন প্রথমে দিল্লি, এরপর নেপাল, তার পর দুবাই হয়ে আমেরিকায় চলে যান। সে ইউএস সিটিজেন।
সর্বশেষ যে দু’জনকে গ্রেফতার হয়েছে, হত্যার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি সম্পর্কে কিছু বলেছে কি না, জানতে চাইলে হারুন বলেন, কলকাতার একটি মার্কেট থেকে হত্যাকারীরা ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি চেয়ার কিনে আনে। সাথে আনেন ক্লোরোফর্ম। সেই চেয়ারে বেঁধে আনারকে বিবস্ত্র করা হয়। এসব কাজ করেছে ফয়সাল। আর হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সিয়াম এনে দিয়েছিল ফয়সালকে।
মোস্তাফিজ ও ফয়সাল হত্যার কাজ শেষ করে দেশে ফিরে শাহীনকে ফোন করে। বলে আমরা কোথায় থাকব। শাহীনের একটা বাসা আছে বসুন্ধরায়। সেখানে তারা যায়। সেখানে গিয়ে শিমুল ভূঁইয়ার সাথে কথা বলতে বলতে ফোন বন্ধ হয়ে যায়। ফয়সাল ও মোস্তাফিজ ছিল ট্রাক ড্রাইভার। তাদের ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়। মোবাইল বন্ধ করে তারা চলে যায় খাগড়াছড়ির গহিন অঞ্চলে। সেখানে পাহাড়ের নিচে পাতাল কালীমন্দির আছে। তারা সেখানে নিজেদের নাম বদলে ফেলে। ফয়সাল পলাশ রায় আর মোস্তাফিজুর শিমুল রায় নাম ধারণ করে। তারা হিন্দু সেজে মন্দিরে অবস্থান করে। তারা বলে, মাকে তারা খুব ভালোবাসে। তারা চুলের ধরন পরিবর্তন করে এবং ধূতি পরে।
এ অবস্থায় হত্যার মূল মোটিভ কী- জানতে চাইলে ডিবি প্রধান হারুন সাংবাদিকদের বলেন, যেকোনো হত্যার পেছনে একটা মোটিভ থাকে। ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার জনপ্রিয় সংসদ সদস্য। তাকে টাকা-পয়সা লেনদেনের কথা বলে কলকাতায় নিয়ে যায় শাহীন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, কারা লাভবান, কারা আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে লাভবান, সেটা আশা করি বের হবে। আনার হত্যার মোটিভ তো অবশ্যই আছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা সুনির্দিষ্ট মোটিভ বলতে পারছি না।
আমরা সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সম্ভাব্য কারণ আমলে নিয়ে তদন্ত করছি। আমরা অনর্থক কাউকে ডাকাডাকি করছি না। নির্দোষ কাউকে হয়রানি করছি না।
ডিবি বলছে, আনোয়ারুল আজিম খুনের ঘটনায় জড়িত হিসেবে এখন পর্যন্ত যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে ফকির ও ফয়সাল আলী ওরফে সাহাজী। এই দু’জন খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। শিমুল ধরা পড়লেও ওই দু’জন পলাতক ছিলেন। বুধবার চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার ২ জন রিমাণ্ডে
এমপি আনার তাকে হত্যার পরিকল্পনা বিষয় বুঝতে পেরে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে চান। তখন আসামি ফয়সাল আলী সাহাজী তাকে পেছন থেকে গলায় ধরে মুখে চেতনানাশক ক্লোরোফর্ম মিশ্রিত রুমাল দিয়ে চেপে ধরেন। এরপর অন্য আসামিরা মিলে তাকে অচেতন করে হত্যা করা হয়। বুধবার পাহাড়ি এলাকা থেকে গ্রেফতার দুই আসামির স্বীকারোক্তিতে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতাউল্লাহ তাদের ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। দুই আসামি হলেন- ফয়সাল আলী সাহাজী (৩৭) ও মো: মোস্তাফিজুর রহমান ফকির (৩৪)।
এ মামলায় আগে গ্রেফতার তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। এর মধ্যে গত ৩ জুন আসামি শিলাস্তি রহমান, ৪ জুন তানভীর ভূঁইয়া, ৫ জুন সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া এবং গত ১৪ জুন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু ওই মামলার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা