এ বাজেট জনগণের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১১ জুন ২০২৪, ০০:১৭
জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের কল্যাণের জন্য উপস্থাপন করা হয়নি। সরকার ও সরকারের মদদপুষ্টদের আখের গোছানোর জন্যই এই বাজেট পেশ করা হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় জনগণের প্রতি এই সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। এই সরকার যত দিন ক্ষমতায় থাকবে তত দিন দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেশকে একটি ঋণনির্ভর দেশে পরিণত করবে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর জামায়াতের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গতকাল রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমির মো: সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।
অধ্যাপক গোলাম পরওয়ার বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। ৭ জানুয়ারি প্রহসনের ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে এ সরকার ক্ষমতা দখল করেছে। অর্থমন্ত্রী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে তথ্য-উপাত্ত পেশ করে যেসব আশার বাণী শুনিয়েছেন, তার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তিনি সুখী-সমৃদ্ধ বলতে যে বাংলাদেশের কথা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাংলাদেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি, পানি-গ্যাসের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাংক লুটপাটসহ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বিদেশে অর্থপাচার ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লাগামহীন দুর্নীতির কারণে চরম কষ্টকর জীবন-যাপন করছেন। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির সূচক নিম্নগামী। মূল্যস্ফীতির কারণে সীমিত আয়ের মানুষ বিপদগ্রস্ত। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু তার বাজেট বক্তৃতা বিশ্লেষণ করলে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থমন্ত্রী খরচের ক্ষেত্রে যে হিসাব পেশ করেছেন, তা কোথা থেকে আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিনের জীবন-যাপনে অপরিহার্য নানা পণ্যের সেবার ওপর বাড়তি কর চাপানো হয়েছে। বাজেটে বড় অঙ্কের ব্যয় মেটাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চার লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এটি অর্জন করতে চলতি সংশোধিত বাজেট থেকে ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি আহরণ করতে হবে, যা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। প্রকৃতপক্ষে সরকারের রাজস্ব নীতি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীনির্ভর হয়ে পড়েছে।
ঋণনির্ভর ও সঙ্কোচনমূলক বাজেট বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাজেটে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এই বিশাল ঋণনির্ভর বাজেট বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা বাস্তবায়িত হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে এবং মুদ্রাবাজারে অনেক বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
বাজেটে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের কোনো কৌশল রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণখেলাপি ও হুন্ডির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কোনো কথা বলা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব করেছে তাতে বিগত মার্চ মাস পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা, যা প্রকৃত চিত্র নয়। বাস্তবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে গোলাম পরওয়ার বলেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট উত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি উল্লেখ করেছেন, ৬ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমানো হবে। অথচ ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির যে হিসাব ধরা হয়েছে, সেটি গড় হিসাব। সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত পণ্য বাস্কেটের ভিত্তিতে হিসাব করা হলে মূল্যস্ফীতি হবে ২০ শতাংশের বেশি।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো দিক থেকেই গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ সামাজিক ন্যায্যতার দিক থেকে বৈষম্যমূলক। তিনি বলেন, বাজেটে সর্বোচ্চ কর হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। কিন্তু ১৫ শতাংশ কর দিয়েই কালো টাকা বৈধ করা যাবে, এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কর ফাঁকিবাজদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
শিক্ষাখাত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শতকরা ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। প্রস্তাবিত বাজেটেও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবেই জিডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে। যদিও শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ বেশি দেখিয়ে অনেকটা শুভঙ্করের ফাঁকির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কৃষি খাতের বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কৃষির উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও কৃষকদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির কোনো নিশ্চয়তা নেই বাজেটে।
শিল্প খাত প্রসঙ্গে জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম খাত হচ্ছে শিল্প। অথচ শিল্পের উন্নয়ন, বিকাশ এবং নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে কোনো দিকনির্দেশনা রাখা হয়নি বাজেটে। নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। শ্রমঘন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকলে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত এবং বেকারত্বও কিছুটা দূর হতো। কিন্তু শিল্পের বিকাশে কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেটে।
চিকিৎসা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাজেটে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রকৃতপক্ষে দেশে চিকিৎসা খাতে চলছে ভয়াবহ অরাজকতা। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার মানে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। বিশেষায়িত বিশেষ শুল্ক ছাড়ে চিকিৎসা যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ পাওয়া যেত। এ ক্ষেত্রে আমদানির শুল্ক হার ছিল ১ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে ২০০টিরও বেশি চিকিৎসা যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশের শুল্ক বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছেন।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বর্তমানে লুটপাটের কারখানায় পরিণত হয়েছে। গ্রাহকগণ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের নামে বিশেষ গোষ্ঠী জনগণের আমানতের টাকা আত্মসাৎ করার যে অপকৌশল গ্রহণ করেছে, তা রোধ করার জন্য বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
বেকারত্বের বিষয়টি তুলে ধরে গোলাম পরওয়ার বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি ও বেকারত্ব। দুর্নীতি কমলে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। কর্মসংস্থানও বাড়বে। ফলে বেকারত্ব কমবে। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ঘরে ঘরে চাকরি কিংবা বেকারত্ব না কমে বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশকে ঋণমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তিন বছর আগে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মাথাপিছু ঋণ ছিল এক লাখ টাকা। বর্তমানে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত তিন বছরে প্রতিটি মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৫৫ হাজার টাকা। ২০২৩ সালের জুন মাসে সরকারি ও বেসরকারি ঋণ ছিল ৯৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তা দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে। যার সুদ দিতে হবে প্রতি বছর সোয়া লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে দেশী ও বিদেশী ঋণ এবং তার সুদ দ্বিগুণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা